নূরানী স্কুল
ইমেইলঃ nuranischool@gmail.com
ফেসবুকঃ fb/NuraniSchoolPAGE
ইউটিউবঃ Nurani School
সম্পাদকঃ ওমর ফারুক

Header Ads

Showing posts with label নবী রাসূলদের জীবনী. Show all posts
Showing posts with label নবী রাসূলদের জীবনী. Show all posts

Saturday, July 11, 2020

জ্ঞান সম্পর্কে হযরত আলী (রাঃ)-এর দশ টি জবাব


একদা ১০ জন লোক হযরত আলীর (রাঃ) নিকট হাজির হলো এবং বলল, “আমরা আপনাকে একটি প্রশ্ন করার অনুমতি চাচ্ছি।”
.
হযরত আলি (রাঃ) বললেন, “স্বাধীনভাবে আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন।”
.
তারা প্রশ্ন করলঃ “জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটা ভাল এবং কেন ভালো? অনুগ্রহ করে আমাদের প্রত্যেকের জন্যে একটি করে জবাব দিন।”
*
জবাবে হযরত আলী (রাঃ) নিম্নলিখিত ১০টি উত্তর দিলেনঃ
*
১) জ্ঞান হলো মহানবীর সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি, আর সম্পদ ফেরাউনের উত্তরাধিকার। সুতরাং জ্ঞান সম্পদের চেয়ে উত্তম।
*
(২) তোমাকে সম্পদ পাহারা দিতে হয়, কিন্তু জ্ঞান তোমাকে পাহারা দেয়। সুতরাং জ্ঞান উত্তম।
*
(৩) একজন সম্পদশালীর যেখানে শত্রু থাকে অনেক, সেখানে একজন জ্ঞানীর অনেক বন্ধু থাকে। অতএব জ্ঞান উত্তম।
*
(৪) জ্ঞান উত্তম, কারণ এটা বিতরণে বেড়ে যায়, অথচ সম্পদ বিতরণে কমে যায়।
*
(৫) জ্ঞান উত্তম, কারণ একজন জ্ঞানী লোক দানশীল হয়, অন্যদিকে সম্পদশালী ব্যক্তি কৃপণ।
*
(৬) জ্ঞান চুরি করা যায় না, কিন্তু সম্পদ চুরি হতে পারে। অতএব জ্ঞান উত্তম।
*
(৭) সময় জ্ঞানের কোন ক্ষতি করে না, কিন্তু সম্পদ সময়ের পরিবর্তনে ক্ষয় পেয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং জ্ঞান উত্তম।
*
(৮) জ্ঞান সীমাহীন, কিন্তু সম্পদ সীমাবদ্ধ এবং গোণা যায়। অতএব জ্ঞান উত্তম।
*
(৯) জ্ঞান হৃদয়- মনকে জ্যোতির্ময় করে, কিন্তু সম্পদ একে মসিলিপ্ত করায় মত্ত। সুতরাং জ্ঞান উত্তম।
*
(১০) জ্ঞান উত্তম। কারণ জ্ঞান মানবতাবোধকে উদ্বুদ্ধ করে যেমন আমাদের মহানবী সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে বলেছেনঃ “আমরা আপনার উপাসনা করি, আমরা আপনারই দাস।” (সুরা ফাতিহাঃ ৪)
.
অন্যদিকে সম্পদ ফেরাউন ও নমরুদকে বিপদগ্রস্ত করেছে। যারা দাবী করে যে তারা ইলাহ।’
.
(#সূত্রঃ হায়াতুস সাহাবা রদীয়াল্লহু আনহুম)
.
সুবহানআল্লাহ! রসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং হযরত আলী (রাঃ) এর জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। .
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ
.।।।
"আমি হলাম ইলমের শহর। আর আলী হল এর দরজা। সুতরাং যে ব্যক্তি শহরে প্রবেশ করতে চায়, সে যেন দরজা দিয়ে আসে।"
_____________
{মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-৪৬৩৭, আলমুজামুল কাবীর লিততাবারী, হাদীস নং- ১০৬১, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-৩২৮৯০, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-৫৭৪২}

Friday, July 10, 2020

হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাঃ) জীবনী ও ঘটনা


আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাঃ): রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ ‘লিকুল্লি উম্মাতিন আমীনুন, ওয়া আমীনু হাজিহিল উম্মাহ আবু উবাইদা- প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে। আর এ মুসলিম জাতির পরম বিশ্বাসী ব্যক্তি আবু উবাইদা।’


তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, গৌরকান্তি, হালকা পাতলা গড়ন ও দীর্ঘদেহের অধিকারী। তাঁকে দেখলে যে কোন ব্যক্তির চোখ জুড়িয়ে যেত, সাক্ষাতে অন্তরে ভক্তি ও ভালোবাসার উদয় হত এবং হৃদয়ে একটা নির্ভরতার ভাব সৃষ্টি হত। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাবী, অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক প্রকৃতির। তবে যে কোন সংকট মুহূর্তে সিংহের ন্যায় চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে ফুটে উঠত। তাঁর চারিত্রিক দীপ্তি ও তীক্ষ্ণতা ছিল তরবারীর ধারের ন্যায়। রাসূলের সা. ভাষায় তিনি ছিলেন উম্মাতে মুহাম্মাদীর ‘আমীন’- বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।


তাঁর পুরো নাম আমীল ইবন আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ আল –ফিহরী আল কুরাইশী। তবে কেবল আবু উবাইদা নামে তিনি সবার কাছে পরিচিত। তাঁর পঞ্চম উর্ধ পুরুষ ‘ফিহরের’ মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। তাঁর মাও ফিহরী খান্দানের কন্যা। সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমারের রা. মন্তব্য হলঃ ‘কুরাইশদের তিন ব্যক্তি অন্য সকলের থেকে সুন্দর চেহারা, উত্তম চরিত্র ও স্থায়ী লজ্জাশীলতার জন্য সর্বশেষ্ঠ। তাঁর তোমাকে কোন কথা বললে মিথ্যা বলবেন না, আর তুমি তাদেরকে কিছু বললে তোমাকে মিথ্যুক মনে করবেন না। তাঁরা হলেন- আবু বকর সিদ্দিক, উসমান ইবন আফফান ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ।’


ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগেই যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন আবু উবাইদা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। হযরত আবু বকরের মুসলমান হওয়ার পরের দিনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের হাতেই তিনি তাঁর ইসলামের ঘোষণা দেন। তারপর তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফ, উসমান ইবন মাজউন, আল-আরকাম ইবন আবিল আরকাম ও তাঁকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির হন। সেখানে যারা সকলেই একযোগে ইসলামের ঘোষণা দেন। এভাবে তাঁরাই হলেন মহান ইসলামী ইমারতের প্রথম ভিত্তি।


মক্কায় মুসলিমদের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আবু উবাইদা শরীক চিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অটল থেকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কামিয়াব হন। কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দু’বার হাবশায় হিজরাত করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহর সা হিজরাতের পর তিনিও মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় সা’দ বিন মুয়াজের সাথে তাঁর ‘দ্বীনী মুয়াখাত’ বা দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বদর যুদ্ধের দিন আবু উবাইদার পরীক্ষার কঠোরতা ছিল সকল ধ্যান-ধারণা ও কল্পনার উর্ধে। যুদ্ধের ময়দানে এমন বেপরোয়াভাবে কাফিরদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকেন যেন তিনি মৃত্যুর প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। মুশরিকরা তাঁর আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের অশ্বারোহী সৈনিকরা প্রাণের ভয়ে দিশেহারা হয়ে দিকবিদিক পালাতে থাকে। কিন্তু শত্রুপক্ষের এক ব্যক্তি বার বার ঘুরে ফিরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। আর তিনিও তার সামনে থেকে সরে যেতে লাগলেন যেন তিনি সাক্ষাত এড়িয়ে যাচ্ছেন।


লোকটি ভীড়ের মধ্যে প্রবেশ করল। আবু উবাইদা সেখানেও তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। অবশেষে সে শত্রুপক্ষ ও আবু উবাইদার মাঝখানে এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। যখন তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তিনি তাঁর তরবারির এক আঘাতে লোকটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছন্ন করে ফেলেন। লোকটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
লোকটি কে? সে আর কেউ নয়। সে আবু উবাইদার পিতা আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ। প্রকৃতপক্ষে আবু উবাইদা তাঁর পিতাকে হত্যা করেননি, তিনি তাঁর পিতার আকৃতিতে শিরক বা পৌত্তলিকতা হত্যা করেছেন। এ ঘটনার পর আল্লাহ তা’আলা আবু উবাইদা ও তাঁর পিতার শানে নিম্নের এ আয়াতটি নাযিল করেন।


‘তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার লোকেরা কখনো তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সা. বিরুদ্ধাচরণ করেছে- তারা তাদের পিতা-ই হোক কিংবা তাদের পুত্র-ই হোক বা ভাই হোক অথবা তাদের বংশ-পরিবারের লোক। তারা সেই লোক যাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং নিজের তরফ হতে একটা রূহ দান করে তাদেরকে এমন সব জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে। তাতে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়েছেন তাঁর প্রতি। এরা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখ, আল্লাহর দলের লোকেরাই কল্যাণপ্রাপ্ত হবে।’ (আল মুজাদিলা- ২২)


আবু উবাইদার এরূপ আচরণে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ, আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান, দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠা, এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রতি তাঁর আমানতদারী তাঁর মধ্যে এমন চূড়ান্ত রূপলাভ করেছিল যে, তা দেখে অনেক মহান ব্যক্তিও ঈর্ষা পোষণ করতেন। মুহাম্মাদ ইবন জাফর বলেনঃ ‘খৃস্টানদের একটা প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির হয়ে বললো- হে আবুল কাসিম! আপনার সাথীদের মাঝ থেকে আপনার মনোনীত কোন একজনকে আমাদের সাথে পাঠান। তিনি আমাদের কিছু বিতর্কিত সম্পদের ফায়সালা করে দেবেন।


আপনাদের মুসলিম সমাজ আমাদের সবার কাছে মনোপূত ও গ্রহণযোগ্য। একথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ ‘সন্ধ্যায় তোমরা আমার কাছে আবার এসো। আমি তোমাদের সাথে একজন দৃঢ়চেতা ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব।’ হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব বলেনঃ ‘আমি সেদিন সকাল সকাল জোহরের নামায আদায়ের জন্য মসজিদে উপস্থিত হলাম। আর আমি এ দিনের মত আর কোন দিন নেতৃত্বের জন্য লালায়িত হইনি। এর একমাত্র কারণ, আমিই যেন হতে পারি রাসূলুল্লাহর সা. এ প্রশংসার পাত্রটি।


রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সাথে জোহরের নামায শেষ করে ডানে বায়ে তাকাতে লাগলেন। আর আমিও তাঁর নজরে আসার জন্য আমার গর্দানটি একটু উঁচু করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি তাঁর চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে দেখতে পেলেন। তাঁকে ডেকে তিনি বললেনঃ ‘তুমি তাদের সাথে যাও এবং সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফায়সালা করে দাও।’ আমি তখন মনে মনে বললামঃ আবু উবাইদা এ মর্যাদাটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল।


আবু উবাইদা কেবল একজন আমানতদারই ছিলেন না, আমানতদারীর জন্য সর্বদা সকল শক্তি পুঞ্জিভূত করতেন। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
বদর যুদ্ধের প্রাক্‌কালে কুরাইশ কাফিলার গতিবিধি অনুসরণের জন্য রাসূল সা. একদল সাহাবীকে পাঠান। তাঁদের আমীর নিযুক্ত করেন আবু উবাইদাকে। পাথেয় হিসাবে তাঁদেরকে কিছু খোরমা দেওয়া হয়। প্রতিদিন আবু উবাইদা তাঁর প্রত্যেক সংগীকে মাত্র একটি খোরমা দিতেন। তাঁরা শিশুদের মায়ের স্তন চোষার ন্যায় সারাদিন সেই খোরমাটি চুষে চুষে এবং পানি পান করে কাটিয়ে দিত।


এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র একটি খোরমা দিতেন। তাঁর শিশুদের মায়ের স্তন চোষার ন্যায় সারাদিন সেই খোরমাটি চুষে চুষে এবং পানি পান করে কাটিয়ে দিত। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র একটি খোরমাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট ছিল। কোন কোন বর্ণনায় ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ অষ্টম হিজরীতে রজব মাসে রাসুল সা. আবু উবাইদার নেতৃত্বে উপকূলীয় এলাকায় কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য একটি বাহিনী পাঠান। কিছু খেজুর ছাড়া তাঁদের সাথে আর কোন পাথেয় ছিল না। সৈনিকদের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ছিল মাত্র একটি খেজুর। এই একটি খেজুর খেয়েই তাঁর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করেন। অবশেষে আল্লাহতায়ালা তাঁদের এ বিপদ দূর করেন। সাগর তীরে তাঁরা বিশাল আকৃতির এক মাছ লাভ করেন এবং তার ওপর নির্ভর করেই তাঁরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। হয়তো এ দুটি পৃথক পৃথক ঘটনা ছিল।


উহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা যখন পরাজয় বরণ করে এবং মুশরিকরা জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মুহাম্মাদ কোথায়, মুহাম্মাদ কোথায়….’। তখন আবু উবাইদা ছিলেন সেই দশ ব্যক্তির অন্যতম যারা বুক পেতে রাসূলকে সা. মুশরিকদের তীর থেকে রক্ষা করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল রাসূলুল্লাহর সা. দাঁত শহীদ হয়েছে, তাঁর কপাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে এবং গণ্ডদেশে বর্মের দুটি বেড়ী বিঁধে গেছে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক বেড়ী দু’টিকে উঠিয়ে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি এগিয়ে এলেন। আবু উবাইদা তাঁকে বললেন, ‘কসম আল্লাহর! আপনি আমাকে ছেড়ে দিন।’ তিনি ছেড়ে দিলেন। আবু উবাইদা ভয় করলেন হাত দিয়ে বেড়ী দু’টি তুললে রাসূল সা. হয়ত কষ্ট পাবেন। তিনি শক্তভাবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে প্রথমে একটি তুলে ফেললেন।


কিন্তু তাঁরও অন্য একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। তখন আবু বকর রা. মন্তব্য করলেনঃ ‘আবু উবাইদা সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ খন্দক ও বনী কুরাইজা অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক চুক্তিতে তিনি একজন সাক্ষী হিসেবে সাক্ষর করেন। খাইবার অভিযানে সাহস ও বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ‘জাতুস সালাসিল’ অভিযানে হযরত আমর ইবনুল আসের বাহিনীর সাহায্যের জন্য দু’শ’ সিপাহীসহ রাসূল সা. আবু উবাইদাকে পিছনে পাঠান। তাঁরা জয়লাভ করেন। মক্কা বিজয়, তায়িফ অভিযানসহ সর্বক্ষেত্রে আবু উবাইদা শরীক ছিলেন। বিদায় হজ্জেও তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সফরসংগী ছিলেন।


ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আবু উবাইদা সর্বক্ষেত্রে ছায়ার ন্যায় সর্বদা তাঁকে অনুসরণ করেন।
সাকীফায়ে বনী সায়েদাতে খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে তুমুল বাক-বিতণ্ডা চলছে। আবু উবাইদা আনসারদের লক্ষ্য করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেনঃ ‘ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমরাই প্রথম সাহায্যকারী। আজ তোমরাই প্রথম বিভেদ সৃষ্টিকারী হয়োনা।’ এক পর্যায়ে হযরত আবু বকর আবু উবাইদাকে বলেন, আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি।


আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে, তুমি এ জাতির সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি।’ এর জবাবে আবু উবাইদা বললেনঃ ‘আমি এমন ব্যক্তির সামনে হাত বাড়াতে পারিনা যাকে রাসূল সা. আমাদের নামাযের ইমামতির আদেশ করেছেন এবং যিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইমামতি করেছেন।’ একথার পর আবু বকরের হাতে বাইয়াত করা হল। আবু বকরের খলীফা হবার পর সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সর্বোত্তম উপদেষ্টা ও সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেন ।আবু বকরের পর হযরত উমার খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আবু উবাইদা তাঁরও আনুগত্য মেনে নেন।


হযরত আবু বকর রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হিজরী ১৩ সনে সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। আবু উবাইদাকে হিমস, ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে দিমাশ্‌ক, শুরাহবীলকে জর্দান এবং ’আমর ইবনুল আসকে ফিলিস্তীনে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করলেন আবু উবাইদাকে। দিমাশ্‌ক, হিমস, লাজেকিয়া প্রভৃতি শহর বিজিত হয় আবু উবাইদার হাতে। ইয়ারমুকের সেই ভয়াবহ যুদ্ধ তিনিই পরিচালনা করেন। ’আমর ইবনুল ’আসের আহ্‌বানে সাড়া দিয়ে বায়তুল মাকদাস বিজয়ে শরীক হন। বায়তুল মাকদাসবাসীরা খোদ খলীফা ’উমারের সাথে সন্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করলে আবু উবাইদাই সে কথা জানিয়ে খলীফাকে পত্র লেখেন। সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য খলীফা ‘জাবিয়া’ পৌঁছলে আবু উবাইদাহ তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। হিজরী ১৭ সনে হযরত খালিদ সাইফুল্লাহকে দিমাশ্‌কের আমীর ও ওয়ালীর পদ থেকে অপসারণ করে খলীফা উমার আবু উবাইদাকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেন। হযরত খালিদ সাইফুল্লাহ লোকদের বলেন, ‘তোমাদের খুশী হওয়া উচিত যে, আমীনুল উম্মাত তোমাদের ওয়ালী।’


আবু উবাইদার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী সিরিয়ায় একের পর এক বিজয় লাভ করে সিরিয়ার সমগ্র ভূখণ্ড দখল করে চলেছে। এ সময় সিরিয়ায় মহামারী আকারে প্লেগ দেখা দেয় এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার শিকারে পরিণত হয়। খলীফা হযরত উমার রা. নিজেই খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য রাজধানী মদীনা থেকে ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছুলেন। অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আবু উবাইদা সেখানে খলীফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রবীণ মুহাজির ও আনসারদের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করলেন। সবাই একবাক্যে সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্থান ত্যাগের পক্ষে মত দিলেন। হযরত উমার সবাইকে আহ্‌বান জানালেন তাঁর সাথে আগামী কাল মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য। তাকদীরের প্রতি গভীর বিশ্বাসী আবু উবাইদা বেঁকে বসলেন।


খলীফাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আ ফিরারুম মিন কাদলিল্লাহ- একি আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন নয়?’ খলীফা দুঃখ প্রকাশ করে বললেনঃ ‘আফসুস! আপনি ছাড়া কথাটি অন্য কেউ যদি বলতো! হাঁ, আল্লাহর তাকদীর থেকে পালাচ্ছি। তবে অন্য এক তাকদীরের দিকে। আবু উবাইদা তাঁর বাহিনীসহ সেখানে থেকে গেলেন। খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার মদীনা পৌঁছে দূত মারফত আবু উবাইদাকে একখানা পত্র পাঠান। পত্রে তিনি লিখেনঃ ‘‘আপনাকে আমার খুবই প্রয়োজন। অত্যন্ত জরুরীভাবে আপনাকে আমি তলব করছি। আমার এ পত্রখানি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে তাহলে সকাল হওয়ার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন। আর যদি দিনের বেলা পৌঁছে তাহলে সন্ধ্যার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন।’’ খলীফা উমারের এ পত্রখানি হাতে পেয়ে তিনি মন্তব্য করেনঃ ‘আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের প্রয়োজনটা কি তা আমি বুঝেছি।


যে বেঁচে নেই তাকে তিনি বাঁচাতে চান। তারপর তিনি লিখলেনঃ ‘‘আমীরুল মু’মিনীন, আমি আপনার প্রয়োজনটা বুঝেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মাঝে অবস্থান করছি। তাদের ওপর যে ‍ আপতিত হয়েছে তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেন। আমার এ পত্রখানি আপনার হাতে পৌঁছার পর আপনি আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দান করুন।’’


হযরত উমার এ পত্রখানি পাঠ করে এত ব্যাকুলভাবে কেঁদেছিলেন যে, তাঁর দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর এ কান্না দেখে তার আশেপাশের লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ ‘আমীরুল মু’মিনীন, আবু উবাইদা কি ইনতিকাল করেছেন?’ তিনি বলেছিলেনঃ ‘না। তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।


হযরত উমারের ধারণা মিথ্যা হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্লেগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে উপদেশমূলক একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। তিনি বলেনঃ ‘‘তোমাদেরকে যে উপদেশটি আমি দিচ্ছি তোমরা যদি তা মেনে চলো তাহলে সবসময় কল্যাণের পথেই থাকবে। তোমরা নামায কায়েম করবে, রমাদান মাসে রোযা রাখবে, যাকাত দান করবে, হজ্জ ও উমরা আদায় করবে, একে অপরকে উপদেশ দেবে, তোমাদের শাসক ও নেতৃবৃন্দকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলবে, তাদের কাছে কিছু গোপন রাখবে না এবং দুনিয়ার সুখ সম্পদে গা ভাসিয়ে দেবে না।


কোন ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ তারও এই একই পরিণতি হবে।’’ সকলকে সালাম জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন। অতঃপর মুয়াজ ইবন জাবালের দিকে তাকিয়ে বলেনঃ ‘মুয়াজ! নামাযের ইমামতি কর।’ এর পরপরই তাঁর রূহটি পবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরম সত্তার দিকে ধাবিত হয়। মুয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলকে লক্ষ্য করে বলেনঃ লোক সকল! তোমরা এ ব্যক্তির তিরোধানে ব্যথা ভারাক্রান্ত। আল্লাহর কসম! আমি এ ব্যক্তির থেকে অধিক কল্যাণদৃপ্ত বক্ষ, পরিচ্ছন্ন হৃদয়, পরকালের প্রেমিক এবং জনগণের উপদেশ দানকারী আর কোন ব্যক্তিকে জানিনা। তোমরা তাঁর প্রতি রহম কর, আল্লাহও তোমাদের প্রতি রহম করবেন। এটা হিজরী ১৮ সনের ঘটনা।


এরপর লোকেরা সমবেত হয়ে আবু উবাইদার মরদেহ বের করে আনলো। মুয়াজ বিন জাবালের ইমামতিতে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হল। মুয়াজ বিন জাবাল, আমর ইবনুল আস ও দাহ্‌হাক বিন কায়েস কবরের মধ্যে নেমে তাঁর লাশ মাটিতে শায়িত করেন। কবরে মাটিচাপা দেওয়ার পর মুয়াজ এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তাঁর প্রশংসা করে বলেনঃ ‘‘আবু উবাইদা, আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন! আল্লাহর কসম! আমি আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি কেবল ততটুকুই বলবো, অসত্য কোন কিছু বলবো না। কারণ, আমি আল্লাহর শাস্তির ভয় করি। আমার জানা মতে আপনি ছিলেন আল্লাহকে অত্যধিক স্মরণকারী, বিনম্রভাবে যমীনের ওপর বিচর‌ণকারী ব্যক্তিদের একজন। আর আপনি ছিলেন সেইসব ব্যক্তিদের অন্যতম যারা তাদের ‘রবের’ উদ্দেশ্যে সিজদারত ও দাঁড়ানোর অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে এবং যারা খরচের সময় অপচয়ও করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে থাকে। আল্লাহর কসম; আমার জানা মতে আপনি ছিলেন বিনয়ী এবং ইয়াতিম-মিসকীনদের প্রতি সদয়। আপনি ছিলেন অত্যাচারী অহংকারীদের শত্রুদেরই একজন।’


খাওফে খোদা, ইত্তেবায়ে সুন্নাত, তাকওয়া, বিনয়, সাম্যের মনোভাব, স্নেহ ও দয়া ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একদিন একটি লোক আবু উবাইদার বাড়ীতে গিয়ে দেখতে পেল, তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। লোকটি জিজ্ঞেস করলোঃ ব্যাপার কি আবু উবাইদা, এত কান্নাকাটি কেন? তিনি বলতে লাগলেনঃ ‘‘একবার রাসূল সা. মুসলমানদের ভবিষ্যত বিজয় ও ধন-ঐশ্বর্যে্যর আলোচনা প্রসঙ্গে সিরিয়ার প্রসঙ্গ উঠালেন। বললেনঃ ‘আবু উবাইদা তখন যদি তুমি বেঁচে থাক, তাহলে তিনটি খাদেমই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। একটি তোমার নিজের, একটি পরিবার-পরিজনের এবং অন্যটি তোমার সফরে সংগী হওয়ার জন্য।


অনুরূপভাবে তিনটি বাহনও যথেষ্ট মনে করবে। একটি তোমার, একটি তোমার খাদেমের এবং একটি তোমার জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য।’ কিন্তু এখন দেখছি, আমার বাড়ী খাদেমে এবং আস্তাবল ঘোড়ায় ভরে গেছে। হায়, আমি কিভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. মুখ দেখাবো? রাসুল সা. বলেছিলেনঃ সেই ব্যক্তিই আমার সর্বাধিক প্রিয় হবে, যে ঠিক সেই অবস্থায় আমার সাথে মিলিত হবে যে অবস্থায় আমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছি।’’


খলীফা হযরত উমার সিরিয়া সফরের সময় দেখতে পেলেন, অফিসারদের গায়ে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ। তিনি এতই ক্ষেপে গেলেন যে, ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং তাদের দিকে পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করতে করতে বললেনঃ তোমরা এত তাড়াতাড়ি অনারব অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছো কিন্তু আবু উবাইদা একজন সাদামাটা আরব হিসেবে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। গায়ে অতি সাধারণ আরবীয় পোশাক, উটের লাগামটিও একটি সাধারণ রশি। খলীফা উমার রা. তাঁর বাসস্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানে আরো বেশী সরল-সাদাসিধে জীবনধারার চিহ্ন। অর্থাৎ একটি তলোয়ার একটি ঢাল ও উটের একটি হাওদা ছাড়া তাঁর বাড়ীতে আর কিছু নেই। খলীফা বললেনঃ আবু উবাইদা, আপনি তো আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন।’ জবাবে আবু উবাইদা বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন, আমাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।


একবার হযরত উমার রা. উপঢৌকন হিসেবে চারশ’ দীনার ও চার হাজার দিরহাম আবু উবাইদার নিকট পাঠালেন। তিনি সব অর্থই সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। নিজের জন্য একটি পয়সাও রাখলেন না। হযরত ’উমার একথা শুনে মন্তব্য করেনঃ ‘আলহামদুলিল্লাহ! ইসলামে এমন লোকও আছে।’


তিনি এতই বিনয়ী ছিলেন যে, সিপাহসালার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সৈনিকদের থেকে তাঁকে পৃথক করা যেত না। অপরিচিত কেউ তাকে সিপাহসালার বলে চিনতে পারতো না। একবার তো এক রোমান দূত এসে জিজ্ঞেস করেই বসে, ‘আপনাদের সেনাপতি কে? সৈনিকরা যখন আঙ্গুর উঁচিয়ে তাঁকে দেখিয়ে দিল, তখন তো সে সেনাপতির অতি সাধারণ পোশাক ও অবস্থান দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।
উৎস: আসহাবে রাসূলের জীবনকথা

সাহাবীদের ঘটনা শুনলে সত্যি চোখে পানি এসে যায়…..........

হযরত সাদ সালামি আল্লাহরনবীর একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি অত্যন্ত গরীব সাহাবী ছিলেন।
গায়ের রং ছিল খুবই কালো এবং মুখের মধ্যে ছিল বসন্তের দাগ| একদিন সাদ (রা: ) রাসূলে পাকের দরবারে বসে কাঁদতে ছিলেন। হুজুর ( সা: ) তাকে কান্না করার কারন জিজ্ঞেস করলেন? জবাবে সাদ (রা: ) বলতে শুরু করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি আপনার হাতে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছি ৮ মাস হল। এই ৮ মাস আমি মদিনার অলিতে গলিতে কত জায়গায় ঘুরলাম বিয়ের জন্য কিন্ত আমি দেখতে অসুন্দর বলে কেউ আমাকে মেয়ে দেয়না।

আমি আপনার সকল সুন্নাত পালন করতে পারলেও আপনার একটি সুন্নাত বিয়ে যা আমি পালন করতে পারিনি । তাই আমি ভয়ে কান্না করছি যদি এই সুন্নাত
না মানার জন্য আল্লাহ্ আমাকে জান্নাত হতে বঞ্চিত করেন।

রাসুল (স: ) সাদকে বললেন এই মদিনার সবচেয়ে ধনী লোক আমর ইবনে ওহাবের মেয়ে মদিনার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে আমি রাসূল তোমার বিয়ে দিয়ে দিলাম। এখন তুমি আমর ইবনে ওহাবের বাড়িতে যাও এবং তাকে গিয়ে বল আমি তার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি ।

সাদ (রা: ) আমর ইবনে ওহাবের বাড়িতে গেলেন এবং আমরইবনে ওহাবকে সব কিছু খুলে বললেন । সাদ (রা: ) এর কথা শুনে আমর ইবনে ওহাব খুব রাগন্নিত হয়ে তার সাথে খারাপ আচরণ করে বাড়ি হতে বের করে দিলেন।

এদিকে আমর ইবনে ওহাবের মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে সব শুনতে পেলেন । যখন আমর ইবনে ওহাব ঘরে ঢুকলেন তার মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো
বাবা তোমাকে এত বড় সাহস কে দিল যে রাসূলের কথা অমান্য করলেন?
আল্লাহর রাসূল আমার জন্য যে ছেলেকে পছন্দ করেছেন আমিও তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিলাম। মেয়ের কথা শুনে আমর ইবনে ওহাব দৌড়ে রাসূলের দরবারে গেলেন এবং রাসূলের কাছে মাফ চাইলেন।

প্রিয় নবীজী সা. তাকে মাফ করে দিলেন। আর সাদ (রা: ) এর বিয়ের জন্য ৬০০ দিরহাম মোহরানা ধার্য করলেন এবং বললেন এখন তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে যাও। কিন্ত সাদ (রা: ) এত গরীব ছিলেন তার পক্ষে ৬০০ দিরহাম জোগাড় করা সম্ভব ছিল না | তাই অন্যান্য সাহাবীরা মিলে সাদ (রা: ) কে সাহায্য করলেন যাতে উনি উনার স্ত্রীর মোহরানা আদায় করেও নতুন বৌয়ের জন্য কিছু সদাই করতে পারেন। ওদিকে সাদ (রা: ) বাজারে চলে গেলেন কেনাকাটা করার জন্য। 

যখন নতুন বৌয়ের জন্য কেনাকাটা করতে দোকানে ঢুকলেন হঠাৎ শুনতে পেলেন মদিনার বাজারে কে যেন জিহাদের ডাক দিচ্ছে ? জিহাদের ডাক শুনে সাদ (রা: ) ভাবলেন আমি সাদ ফুলের বিছানা বাসর ঘরে নতুন স্ত্রীর কাছে যাবো না আমি রাসূলের মহব্বতে জিহাদে যাবো । তাই তিনি বিয়ের টাকা খরচ করে যুদ্ধের সরঞ্জাম ক্রয় করে জিহাদে চলে গেলেন।

এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সাদ (রা: ) একের পর এক কাফিরকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠাতে লাগলেন। যুদ্ধ করতে করতে এরকম হঠাৎ সাদ (রা:) শাহাদাতের পেয়ালায় শরবত পান করে শহীদ হয়ে গেলেন। এদিকে যুদ্ধ শেষ হল। দূর হতে দেখা যায় কার যেন লাশ পড়ে আছে ? রাসুল (স: ) ও সাহাবীরা কাছে গিয়ে দেখলেন এ যে সাদের লাশ। মাথার লোহার টুপি ভেঙ্গে মগজ বের হয়ে গেছে আর জিহ্বা বের হয়ে আছে।

সাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে রাসূল (স: ) কেঁদে দিলেন আবার পরক্ষণেই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং আবার আকাশ হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। একজন যুবক সাহাবী আবু লুবাবা রাসূলকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

রাসুল (স: ) বললেন আমার সাদ ফুলের বিছানা বাসর ঘরে যায়নি, আমার মহব্বতে শহীদ হয়ে গেল তাই স্নেহের কারণে আমার চোখ হতে পানি ঝড়ে পড়ল।
আর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলাম কারণ আল্লাহ আমার সাদকে খুব সুন্দর একটা মাকাম দান করেছেন আর চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হল আমার সাদ শহীদ হয়েছে তাই আকাশের সব দরজা খুলে গিয়েছে।

বেহেস্ত হতে অসংখ্য হুর দৌড়ে আসতেছে যে কার আগে কে সাদকে কোলে নিবে ? দৌড় দেওয়ার কারণে হুরদের সামনের পর্দা সরে যাচ্ছিলো যা দেখে আমি রাসূল লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলাম|


Wednesday, July 8, 2020

ইউসুফ আ. বন্দিজীবনের গল্প ও যেভাবে কারামুক্তি পেলেন জেনে নিন

বাদশাহ নিজ স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে আশ্বস্ত হলেন এবং ইউসুফ আ. এর জ্ঞান গরিমায় বিমুগ্ধ হয়ে আদেশ দিলেন যে, তাকে কারাগার থেকে বাইরে নিয়ে এসো। আদেশের সাথে সাথে বাদশাহর জনৈক দূত এ বার্তা নিয়ে কারাগারে পৌঁছলো।


ইউসুফ আ. সুলম্বা বন্দিজীবনের দুঃসহ যাতনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন এবং মনে মনে মুক্তি কামনা করছিলেন। কাজেই বাদশাহর ফরমানকে সুযোগ মনে করে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি সরাসরি তা করলেন না। বরং আল্লাহ পাক স্বীয় পয়গাম্বরগণকে যে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন, সেই মর্যাদার আলোকে তাঁদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার ব্যবস্থা করলেন।

اِرْ جِعْ اِلى رَبِّكَ فَسْئَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ الّتِىْ قَطَّعْنَ اَيْدِيَهُنَّ ط اِنَّ رَبِّيْ بِكَيْدِ هِنَّ عَلِيْمٌ0

অর্থঃ ফিরে যাও তোমরা মনিবের কাছে এবং তাকে জিজ্ঞেস করো ঐ রমনীদের কী অবস্থা, যারা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল? আমার রব তো তাদের ছলনা সবই অবগত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫০)

ইউসুফ আ. বললেন, তুমি বাদশাহর কাছে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করো যে, যে সকল মহিলারা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারে বাদশাহ জানেন কি না? এবং আমাকে নির্দোষ বলে জানেন কি না?

হযরত ইউসুফ আ. কারাগার থেকে মুক্তিলাভের সুযোগ পাওয়ার পরও সেই সুযোগ গ্রহণ করলেন না, বরং আগে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করাতে চাইলেন। তাই বাদশাহ যখন ইউসুফ আ. কে মুক্ত করে রাজদরবারে তার নিকট নেয়ার জন্য দূত পাঠালেন, তখন তাকে বাদশাহর নিকট ফেরত পাঠিয়ে দেন এবং বলে পাঠান যে, যে মহিলারা ইউসুফ আ. কে দেখে হতভম্ব হয়ে হাত কেটে ছিল, তাদের মাধ্যমে যেন তিনি ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত দোষীকে সনাক্ত করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَ قَالَ الْمَلِكُ ائْتُوْنِیْ بِهٖ ۚ فَلَمَّا جَآءَهُ الرَّسُوْلُ قَالَ ارْجِعْ اِلٰی رَبِّکَ فَسْـَٔلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَۃِ الّٰتِیْ قَطَّعْنَ اَیْدِیَهُنَّ ؕ اِنَّ رَبِّیْ بِکَیْدِهِنَّ عَلِیْمٌ○

অর্থঃ বাদশাহ বললেন, ইউসুফকে (মুক্ত করে) আমার নিকট নিয়ে এসো। যখন দূত (এ পয়গাম নিয়ে) ইউসুফ আ. এর নিকটে এলো, তিনি তাকে বললেন, তোমার মনিবের নিকট ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞাসা করো সেই মহিলাদের কী হাল যারা হাত কেটেছিল? নিশ্চয়ই আমার প্রভু তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫০)

##আযীয পত্নীর নাম উল্লেখ না করার কারণ##

এখানে এ বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য যে, ইউসুফ আ. এখানে ঐ সকল মহিলাদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা হাত কেটেছেন, কিন্তু আযীয পত্নীর নাম উল্লেখ করেননি। অথচ সে-ই ছিল ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু।

এর কারণ হচ্ছে, যেহেতু ইউসুফ আ. আযীযঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন, তাই ভদ্রতার খাতিরে সরাসরি আযীয পত্নীর নাম উল্লেখ করেননি। তবে তার জানা আছে যে, সেই মহিলাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলেই আযীয পত্নীর কথা এমনিতেই বেরিয়ে আসবে।

আরেক কারণ এই যে, নিজের পবিত্রতা প্রমাণ করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। আর তা এ মহিলাদের মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে যেতে পারে এবং তাতে তাদের তেমন কোনো অপমানও নেই। তারা সত্য কথা স্বীকার করলে শুধু পরামর্শ দেওয়ার দোষ তাদের ঘাড়ে চাপবে। কিন্তু আযীয পত্নীর অবস্থা এরূপ ছিল না। তাই সরাসরি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে, তাকে ঘিরেই তদন্তকার্য অনুষ্ঠিত হতো। ফলে তার অপমান বেশী হতো।

তৃতীয় কারণ এই যে, আযীয পত্নী আযীয মিসর-এর নিকট ঘটনা অস্বীকার করে ইউসুফ আ. এর উপর দোষ চাপালেও হস্ত কর্তনকারিণী মহিলাদের নিকট নিজের সব দোষ অকাতরে স্বীকার করেছেন এবং তাদের সামনেই ইউসুফ আ. কে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না করলে কঠোর শাস্তি প্রদানের হুমকি দিয়েছেন। সুতরাং হস্ত কর্তনকারিণী মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলেই সত্য ঘটনা প্রমাণ হয়ে পড়বে এবং ঘটনার রহস্য আগা-গোড়া সব উদঘাটিত হয়ে যাবে। আর এতে করে ইউসুফ আ. এর নির্দোষিতা তো প্রমাণ হবেই, অধিকন্তু তাঁর সততা, সৎপরায়ণতা ও চারিত্রিক পবিত্রতাও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
ইউসুফ আ. সাথে সাথে আরো বললেন, “আমার পালনকর্তা তাদের মিথ্যা ও ছল-চাতুরি সম্পর্কে সম্যক অবগত।” সুতরাং আমি চাই যে, বাদশাহও বাস্তব সত্য সম্পর্কে অবগত হোন এবং তিনি যেন বুঝতে পারেন যে, ইউসুফ আসামী হিসাবে জেলে ছিলেন না, বরং মজলুম হয়ে জেলে ছিলেন।

কুরআন মাজীদের আয়াতের এ অংশে সূক্ষ্মভাবে ইউসুফ আ. এর পবিত্রতার কথাও বর্ণিত হয়েছে। বাদশাহ তৎক্ষণাৎ ইউসুফ আ. এর দাবী অনুযায়ী হস্ত কর্তনকারিণী মহিলাদরেকে জিজ্ঞাসা করে ঘটনার তদন্ত করলেন। তখন যুলাইখা ও অন্যসব মহিলা বাস্তব ঘটনা স্বীকার করলো। পবিত্র কুরআনে নিম্নবর্ণিত আয়াতে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে,

قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ اِذْ رَاوَدْتُّنَّ یُوْسُفَ عَنْ نَّفْسِهٖ ؕ قُلْنَ حَاشَ لِلّٰهِ مَا عَلِمْنَا عَلَیْهِ مِنْ سُوْٓءٍ ؕ قَالَتِ امْرَاَتُ الْعَزِیْزِ الْـٰٔنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ ۫ اَنَا رَاوَدْتُّهٗ عَنْ نَّفْسِهٖ وَ اِنَّهٗ لَمِنَ الصّٰدِقِیْنَ○

অর্থঃ বাদশাহ মহিলাদেরকে বললেন, তোমাদের ঘটনা সম্পর্কে কী মূল্যায়ন যখন তোমরা ইউসুফকে কামনা চরিতার্থ করার জন্য ফুঁসলিয়েছিলে? তারা বললো, সুবহানাল্লাহ! আমরা তাঁর সম্পর্কে মন্দ কিছু জানি না। তখন আযীযপত্নী বললো, এখন সত্য কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আমিই তাকে স্বীয় কামনা চরিতার্থের জন্য ফুঁসলিয়েছিলাম এবং নিঃসন্দেহে সে-ই সত্যবাদী। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫১)

স্বীয় পবিত্রতা ও সত্যবাদিতা প্রকাশ হওয়ার পর ইউসুফ আ. আশ্বস্ত হলেন। অতঃপর নিজের এ প্রক্রিয়ার পক্ষে সাফাই প্রকাশ করে বললেন,

ذٰلِکَ لِیَعْلَمَ اَنِّیْ لَمْ اَخُنْهُ بِالْغَیْبِ وَ اَنَّ اللهَ لَا یَهْدِیْ کَیْدَ الْخَآئِنِیْنَ○

অর্থঃ আমার এ তদন্ত কামনা এজন্য যে, যাতে আযীযে মিসর জানতে পারেন, আমি গোপনে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আর আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে এগুতে দেন না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫২)

মিসরের বাদশাহ তখন ইউসুফ আ. এর সততা, সাধুতা ও বিশ্বস্ততায় প্রীত ও সন্তুষ্ট হলেন। তাই পুনরায় দূতকে ইউসুফ আ. এর নিকট পাঠিয়ে বললেন, ইউসুফ আ. কে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার একান্ত উপদেষ্টা নির্বাচিত করবো।

নির্দেশ অনুযায়ী ইউসুফ আ. কে সসম্মানে কারাগার থেকে রাজ দরবারে নিয়ে আসা হলো। অতঃপর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ফলে তাঁর যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বাদশাহ বললেন, “আপনি আজ থেকে আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব।” কুরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াতে এ বিষয়টি বিবৃত হয়েছে,

وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُوْنِیْ بِهٖۤ اَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِیْ ۚ فَلَمَّا کَلَّمَهٗ قَالَ اِنَّکَ الْیَوْمَ لَدَیْنَا مَکِیْنٌ اَمِیْنٌ○

অর্থঃ বাদশাহ বললেন, তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের একান্ত সহকারী বানাবো। অতঃপর তিনি যখন তার সাথে মতবিনিময় করলেন, তখন বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের কাছে আজ থেকে বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৪)

ইমাম বাগাবী রহ. বর্ণনা করেন, যখন বাদশাহর দূত দ্বিতীয়বার কারাগারে ইউসুফ আ. এর কাছে পৌঁছলো এবং বাদশাহর পয়গাম পৌঁছলো, তখন ইউসুফ আ. সব কারাবাসীর জন্য দু‘আ করলেন এবং গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান করলেন। অতঃপর তিনি বাদশাহর দরবারে পৌঁছে এই দু‘আ পড়লেন,

حَسْبِىْ رَبِّىْ مِنْ دُنْيَايَ وَحَسْبِىْ رَبِّىْ مِنْ خَلْقِه، عَزَّجَارُهٗ وَجَلَّ ثَنَاءُهٗ وَلَا اِلٰهَ غَيْرُهٗ،

অর্থঃ আমার দুনিয়ার জন্য আমার পালনকর্তাই যথেষ্ট এবং সকল সৃষ্টির মুকাবিলায় আমার রবই আমার জন্য যথেষ্ট। যে তাঁর আশ্রয়ে আসে, সে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে, তার স্থান সিফাত উচ্চ মর্যদার হয়ে যায় তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।

অতঃপর ইউসুফ আ. আরবী ভাষায় সালাম প্রদান করেন, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” এবং বাদশাহর জন্য হিব্রু ভাষায় দু‘আ করেন। বাদশাহ অনেক ভাষা জানতেন, কিন্তু আরবী ও হিব্রু ভাষা তার জানা ছিল না। ইউসুফ আ. বলে দেন যে, সালাম আরবী ভাষায় এবং দু‘আ হিব্রু ভাষায় করা হয়েছে।

এ রিওয়ায়েতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাদশাহ ইউসুফ আ. এর জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও উপলব্ধির জন্য তাঁর সাথে বিভিন্ন ভাষায় কথাবার্তা বলেন। ইউসুফ আ. তাকে প্রত্যেক ভাষায়ই উত্তর দেন এবং সাথে সাথে আরবী ও হিব্রু এই দু’টি অতিরিক্ত ভাষাও শুনিয়ে দেন। এতে যোগ্যতা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা গভীরভাবে রেখাপাত করে।

অতঃপর বাদশাহ বললেন, আমি আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা সরাসরি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। ইউসুফ আ. প্রথমে মূল স্বপ্ন সম্বন্ধে এমন বিবরণ দিলেন, যা আজ পর্যন্ত বাদশাহ নিজেও কারো কাছে বর্ণনা করেননি। অতঃপর সেই স্বপ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করলেন।

বাদশাহ বললেন, আমি আশ্চর্য বোধ করছি যে, আপনি এসব বিষয় কি করে জানলেন? ইউসুফ আ. বললেন, এটা আমার, আপনার ও সকলের প্রভু-প্রতিপালক মহান আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন।
অতঃপর বাদশাহ পরামর্শ চাইলেন যে, এখন কি করা দরকার? ইউসুফ আ. বললেন, প্রথম সাত বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এ সময় অধিকতর পরিমাণে চাষাবাদ করে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে, জনগণকে অধিক ফসল ফলানোর জন্য নির্দেশ দিতে হবে এবং উৎপন্ন ফসলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছড়ার মধ্যে নিজের কাছে সঞ্চিত রাখতে হবে।

এভাবে দুর্ভিক্ষের সাত বছরের জন্য মিসরবাসীদের কাছে প্রচুর শস্যভাণ্ডার মজুত থাকবে এবং আপনি তাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবেন। এমতাবস্থায় রাজস্ব আয় ও খাস জমি থেকে যে পরিমাণ ফসল সরকারের হাতে আসবে, তা ভিনদেশী লোকদের জন্য রাখতে হবে। কারণ এ দুর্ভিক্ষ হবে সুদূর দেশ অবধি বিস্তৃত। ভিনদেশিরা তখন আপনার মুখাপেক্ষী হবে। আপনি খাদ্যশস্য দিয়ে সেসব আর্তমানুষকে সাহায্য করবেন। বিনিময়ে যৎকিঞ্চিত মূল্য গ্রহণ করলেও সরকারি ধনভাণ্ডারে অভূতপূর্ব অর্থ সমাগত হবে।

এ পরামর্শ শুনে বাদশাহ মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়ে বললেন, এ বিরাট পরিকল্পনার ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে এবং কে করবে? ইউসুফ আ. তাকে যথাবিহিত পরামর্শ দিয়ে বললেন,

قَالَ اجْعَلْنِیْ عَلٰی خَزَآئِنِ الْاَرْضِ ۚ اِنِّیْ حَفِیْظٌ عَلِیْمٌ○

অর্থঃ আমাকে দেশের ধনভাণ্ডার নিযুক্ত করুন। আমি (আল্লাহর রহমতে) বিশ্বস্ত রক্ষক ও বেশ অভিজ্ঞ। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৫)

অর্থাৎ জমির উৎপন্ন ফসলসহ দেশীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে আমি সক্ষম এবং ব্যয়ের খাত ও পরিমাণ সম্পর্কেও আমার পুরোপুরি জ্ঞান আছে। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন)

একজন অর্থমন্ত্রীর মাঝে যেসব গুণ থাকা দরকার, উপযুক্ত দু’টি শব্দের মধ্যে ইউসুফ আ. তার সবগুলোই বর্ণনা করে দিলেন। কেননা, অর্থমন্ত্রীর জন্যে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হচ্ছে সরকারি ধন-সম্পদ বিনষ্ট থেকে না দেওয়া; বরং পূর্ণ হিফাযত সহকারে একত্র করা এবং অনাবশ্যক ও ভ্রান্ত খাতে ব্যয় না করা। দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে, যেখানে যে পরিমাণ ব্যয় করা দরকার, সেখানে সেই পরিমাণ ব্যয় করা এবং এক্ষেত্রে কোনো কমবেশি না করা। حَفِیْظٌ শব্দটি প্রথম প্রয়োজনীয় গুণ এবং عَلِیْمٌ শব্দটি দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় গুণের নিশ্চয়তা বহন করছে।

বাদশাহ যদিও ইউসুফ আ. এর গুণাবলীতে মুগ্ধ ও তাঁর তাক্বওয়া ও বুদ্ধিমত্তায় পুরোপুরি বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলেন, তথাপি কার্যত তাঁকে অর্থমন্ত্রী পদ সোপর্দ করলেন না, বরং আরো বৃহত্তর উদ্দেশ্যে তাঁকে এক বছর পর্যন্ত একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে রাজ দরবারে রেখে দিলেন।

অতঃপর এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বাদশাহ শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ই নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর নিকট সোপর্দ করে তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে দেন। সম্ভবত এই বিলম্বের কারণ ছিল এই যে, নিকট সান্নিধ্যে রেখে তাঁর চরিত্র ও অভ্যাস সম্পর্কে বাদশাহর পুরোপুরি অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন

অতঃপর হযরত ইউসুফ আ. পিতা-মাতাকে নিয়ে রাজসিংহাসনে বসালেন। এ সময় পিতা-মাতা ও ভাইয়েরা সবাই ইউসুফ আ. এর সামনে সিজদা করলেন। তখন ইউসুফ আ. ইয়াকুব আ. কে বললেন, আব্বাজান! এটাই আমার সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা, যা আমি দেখেছিলাম যে, এগারেটি তারা এবং সূর্য চন্দ্র আমার জন্য সিজদা করছে। পবিত্র কুরআনে এ সম্বন্ধে ইরশাদ হয়েছে,


وَرَفَعَ اَبَوَیْهِ عَلَی الْعَرْشِ وَخَرُّوْا لَهٗ سُجَّدًا ۚ وَقَالَ یٰۤاَبَتِ هٰذَا تَاْوِیْلُ رُءْیَایَ مِنْ قَبْلُ ۫ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّیْ حَقًّا

অর্থঃ এবং তিনি পিতা-মাতাকে সিংহাসনের উপর বসালেন। তখন সবাই তার সামনে সিজদাবনত হলেন। ইউসুফ আ. বললেন, হে আমার আব্বাজান! এ হলো আমাদের আগেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আমার পালনকর্তা তাকে সত্যে পরিণত করেছেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০০)

উপরোল্লিখিত আয়াতে اَبَوَیْهِ বলে পিতা-মাতা উভয়জনের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ইউসুফ আ. এর মাতা তাঁর শৈশবেই ইন্তিকাল করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তারপর ইয়াকুব আ. ইউসুফ এর মাতার বোন লায়্যাকে বিবাহ করেছিলেন, তিনি ইউসুফ আ. এর খালা হওয়ার দিক দিয়ে মায়ের মতোই ছিলেন, আবার পিতার বিবাহিত স্ত্রী হওয়ার দিক দিয়েও মাতাই ছিলেন। তাই আয়াতে তাদেরকে اَبَوَیْهِ (মা-বাবা) বলা হয়েছে।

وَخَرُّوْا لَهٗ سُجَّدًا “

সবাই হযরত ইউসুফ আ. এর সামনে সিজদা করলেন” আয়াতে বর্ণিত উক্ত সিজদা সম্পর্কে রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এ সিজদাটি ছিল কৃতজ্ঞতাসূচক। আর এটা ইউসুফ আ. এর জন্য নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল।

কেউ কেউ বলেন, উপাসনামূলক সিজদা প্রত্যেক পয়গাম্বরের শরী‘আতেই আল্লাহ ছাড়া কারো জন্যেই বৈধ ছিল না। কিন্তু তা‘জীমী বা সম্মানসূচক সিজদা পূর্ববর্তী পয়গাম্বরগণের শরী‘আতে বৈধ ছিল। সেই হিসেবে এটা তাঁর জন্য সম্মানসূচক সিজদাও হতে পারে। তবে শিরকের সিঁড়ি হওয়ার কারণে ইসলামী শরী‘আতে তাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এরপর ইউসুফ আ. পিতা-মাতার সামনে কিছু অতীত কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলেন।

এখানে এটা অনুধাবনযোগ্য যে, যতটুকু দুঃখ-কষ্ট হযরত ইউসুফ আ. এর উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, ততটুকু দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন যদি কেউ হয় এবং লম্বাদিনের বিচ্ছেদ ও নৈরাশ্যের পর পিতা-মাতার সাথে মিলন ঘটে, তাহলে সে পিতা-মাতার সামনে নিজের কাহিনী কিভাবে বর্ণনা করবে, আর কতটুকু কাঁদবে এবং কাঁদাবে তা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু এখানে উভয়পক্ষই হচ্ছেন আল্লাহ পাকের পয়গাম্বর ও রাসূল। তাঁদের কার্যপদ্ধতি অনুপম আদর্শে ভাস্বর। তাই তো ইয়াকুব আ. এর লম্বা বিরহী প্রিয় ছেলে হাজারো দুঃখ-কষ্টের প্রান্তর অতিক্রম করে যখন পিতার সাথে মিলিত হলেন, তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদের সবাইকে গ্রাম থেকে মিসরে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেওয়ার পরেও।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০০)

হযরত ইউসুফ আ. এর দুঃখ-কষ্ট যথাক্রমে তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল: এক. ভাইদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন এর দুঃখ-কষ্ট।

দুই. পিতা-মাতার কাছ থেকে লম্বাদিনের বিচ্ছেদ এর দুঃখ-কষ্ট।

তিন. কারাগারের কষ্ট।

আল্লাহ তা‘আলার এ বিশিষ্ট পয়গাম্বর স্বীয় বিবৃতিতে প্রথমে ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করে কারাগার প্রসঙ্গ থেকে কথা শুরু করেছেন।

কিন্তু এতেও কারাগারে প্রবেশ করা এবং সেখানকার কষ্ট ক্লেশের বর্ণনা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। বরং জেলখানা থেকে অব্যহতির কথা আল্লাহর কৃতজ্ঞতাসহ বর্ণনা করেছেন। তাতে এ কথা অনায়াসে ফুটে উঠেছে যে, তিনি কারাগারে ছিলেন এবং মুক্তি পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছেন।

এখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, ইউসুফ আ. কারাগার থেকে বের হওয়ার কথা তো উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ভাইয়েরা যে তাঁকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল, তা এদিক দিয়েও উল্লেখ করেননি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ঐ কূপ থেকে বের করেছেন। কেননা, ভাইদের অপরাধ তো আগেই মাফ করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।” তাই কোনোভাবে কূপের কথা উল্লেখ করে ভাইদেরকে লজ্জা দেওয়া সমীচীন মনে করেননি।

এরপর ছিল পিতা-মাতা থেকে সুলম্বা বিচ্ছেদ ও তার প্রতিক্রিয়াদি বর্ণনা করার বিষয়। তিনি এসব বিষয় থেকে পাশ কাটিয়ে শুধু শেষ পরিণতি ও পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাতের কথা আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞতাসহ উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ পাক আপনাদেরকে গ্রাম থেকে মিসর শহরে এনে দিয়েছেন।

এখানে এই নি‘আমতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইয়াকুব আ. এর বাসভূমি ছিল গ্রামে, সেখানে জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে শহরে রাজকীয় সম্মানের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন।

এখন শুধু প্রথম অধ্যায়টি অবশিষ্ট রইলো অর্থাৎ ভাইদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রসঙ্গ। একেও শয়তানের ঘাড়ে চাপিয়ে এভাবে চুকিয়ে দিলেন যে, আমার ভাইয়েরা এরূপ ছিল না, কিন্তু মালা‘উন শয়তান তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে কলহ সৃষ্টির এ কাজটি করিয়েছে।

Wednesday, November 27, 2019

হযরত মুসা (আঃ) একদিন স্রষ্টার কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ

হযরত মুসা (আঃ) একদিন স্রষ্টার কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ "হে প্রভু! আমার অনুসারীদের মধ্যে কে
সবচেয়ে বড় পাপি?"



স্রষ্টার উত্তরঃ "যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই পথ অতিক্রম করবে, সে ব্যক্তি-ই হলো তোমার অনুসারীদের মধ্যে বড় পাপি" স্রষ্টার কথানুযায়ী হযরত মুসা (আঃ) বসে দেখছেন, কিছুক্ষণ পর দেখলেন এক ব্যাক্তি ছোট একটি ছেলেকে কোলে করে পথ অতিক্রম করছে।

মুসা(আঃ) বুঝে ফেললেন এই সেই বড় পাপি মুসা(আঃ) স্রষ্টাকে বললেনঃ "প্রভু, এখন আমাকে সবচেয়ে নেকী মানুষটিকে দেখান।"

স্রষ্টার উত্তরঃ "সূর্য্য ডুবার সাথে সাথে যে লোকটি তোমার পূর্বস্থান দিয়ে চলে যাবে সেই হইলো সবচেয়ে নেকী"

মুসা(আঃ) সূর্য ডুবার বেশ আগের থেকে বসে রইলেন যেই সূর্য্য ডুবছিলো দেখলেন সে সকালের ব্যাক্তি-ই ছোট ছেলেকে কোলে করে ফিরে যাচ্ছে। মুসা(আঃ) হতভম্ব হয়ে স্রস্টাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
"প্রভু একই ব্যক্তি মহা পাপি আবার মহা নেকী" .

স্রষ্টা বললেনঃ "হে- মুসা! সকালে যখন এই ব্যাক্তি ছেলেকে সাথে নিয়ে তোমাকে অতিক্রম করে জঙ্গলে প্রবেশ করলো, তখন কোলের ছেলেটি বাবাকে প্রশ্ন করে ছিলো, বাবা! এই জঙ্গল কতবড়?
বাবা উত্তরে বলেছিলো,অনেক বড়। ছেলে আবার প্রশ্ন করলো, বাবা! জঙ্গল থেকে কি বড় কোনো কিছু আছে? তখন বাবা বলেছিলো, হ্যাঁ বাবা! ঐ পাহাড়গুলো জঙ্গল থেকে বড়। ছেলে পুনরায় প্রশ্ন করলো,পাহাড় থেকে কি বড় কিছু আছে? বাবা বললো, আছে, এই আকাশ। ছেলে আবার প্রশ্ন করলো, আকাশ থেকে কি বড় কিছু আছে? সেই ব্যক্তি বললো, হ্যাঁ, আমার পাপ এই আকাশ থেকেও বড়।
ছেলে বাবার এ উত্তর শোনে বললো, বাবা! তোমার পাপ থেকে বড় কি কোনো কিছু নেই? তখন বাবাটি চিৎকার দিয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো আমার পাপ থেকেও অনেক অনেক বড় আমাদের স্রস্টার রহমত হে-মুসা! এই ব্যক্তির পাপের অনুভূতি ও অনুশোচনা আমার এতো পছন্দ হয়েছে যে সবচেয়ে পাপি ব্যক্তিকে সবচেয়ে' নেকী ব্যক্তি বানিয়ে দিয়েছি। মনে রাখবা আমার শাস্তির হাত থেকে ক্ষমার হাত বহুগুন বড়।

হে প্রভু আপনি আমাদের সকলকে পিছনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে সামনের দিনগুলোতে সত্যপথে চলার তৌফিক দান করুন... আমিন

Wednesday, September 11, 2019

বনি ইসরাইলের বারসিসার কাহিনী

বারসিসা ছিল বনী ঈসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক,‘আবিদ’। তার নিজের মন্দির ছিল আর সেখানে সে একাগ্রভাবে নিজেকে উপাসনায় নিয়োগ করত।

বনী ঈসরাইলের তিন জন পুরুষ জিহাদে যেতে চাচ্ছিল, তাদের একমাত্র বোনকে কোথায় রেখে যাবে বুঝতে পারছিল না।তারা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কোথায় আমরা আমাদের বোনকে রেখে যেতে পারি? তাকে তো আমরা একা ফেলে যেতে পারিনা। কোথায় তাকে রেখে যাওয়া যায়?’ তখন তারা তাদেরকে বলল, ‘তাকে রেখে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে তাকে ঐ উপাসকের কাছে রেখে যাওয়া, সেই-ই সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি, আর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তোমাদের বোনকে তার কাছে রেখে যাও,
সে তার খেয়াল রাখবে’। তারা আবিদের নিকট গেল। তাকে সব বর্ণনা করে বলল, ‘এই হল অবস্থা - আমরা জিহাদে যেতে চাই, আপনি কি কষ্ট করে আমাদের বোনকে দেখে রাখতে পারবেন?’ সে বলল, ‘আমি তোমাদের থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার কাছ থেকে চলে যাও’। তখন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করল, ‘তুমি তাকে কার কাছে রেখে আসবে? তুমি যদি তার খেয়াল না রাখো তাহলে হয়ত কোন দুষ্ট লোক তার খেয়াল রাখবে, আর তারপর তো তুমি জানোই কী ঘটবে! তুমি কি করে এই ভাল কাজটা তোমার হাতছাড়া করে দিতে পার?’

দেখুন ! শয়তান তাকে ভাল কাজে উৎসাহিত করছে! তো সে তাদেরকে আবার ডেকে এনে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তার খেয়াল রাখব, কিন্তু সে আমার সাথে আমার মন্দিরে থাকতে পারবে না,
আমার আরেকটা বাড়ি আছে সে সেই ঘরে থাকবে’। সে মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি ওখানে থাক, আমি আমার মন্দিরে থাকব’। তো মেয়েটা সেই বাড়িতে একটা ঘরে থাকত, আর সেই ধর্মযাজক তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসে তার নিজের দরজার বাইরে রেখে দিত। সে মেয়েটির বাড়িতে পর্যন্ত যেত না, নিজের দরজার বাইরেই খাবার রেখে দিত আর মেয়েটিকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে খাবার নিয়ে যেতে হত; সে মেয়েটির দিতে তাকিয়ে দেখতে পর্যন্ত ও চাইত না। তখন শয়তান আবার তার কাছে এসে বলল, ‘তুমি করছটা কি? তুমি কি জানো না মেয়েটা যখন তার ঘর থেকে বের হবে আর তোমার মন্দির পর্যন্ত আসবে লোকে তাকে দেখতেপাবে? তোমার উচিত তার দরজায় যেয়ে খাবারটা রেখে আসা।’ সে বলল,‘হ্যাঁ, আসলেই’।

শয়তান কিন্তু তার সাথে সামনা-সামনি কথা বলছেনা,তাকে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। ধর্মযাজক ‘আবিদ তাই এবার খাবার নিয়ে মেয়েটির দরজা পর্যন্ত রেখে আসতে শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল, এরপর শয়তান তাকে বলল, ‘মেয়েটা এখনও তার দরজা খুলছে আর বাইরে বের হয়ে আসছে প্লেট নেয়ার জন্য, কেউ তাকে দেখে ফেলতেপারে, তোমার উচিত প্লেটটা তার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসা’। শয়তান কিনাতাকে বলছে আরো ভাল কাজ করতে! তাই সে খাবারের প্লেটটা ঘরে রাখা আরম্ভ করল, সেখানে রেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। এভাবে আরো কিছুদিন পার হলো। আর ওদিকে জিহাদ চলতে থাকায় ভাইদেরফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছিল। শয়তান আবারো তার কাছে আসল, বলল, ‘আচ্ছা, তুমি তাকে এভাবে একা ছেড়ে দিবে,

কেউ তো নেই যে তার দিকে একটু খেয়াল রাখবে, একটু কথা বলবে।
সে যেন জেলখানায় আবদ্ধ হয়ে আছে, কথা বলার কেউ নেই। তুমি কেন ওর দায়িত্ব নিচ্ছ না? ওর সাথে একটু সামাজিকতা বজায় রেখে তো চলতে পার, যেয়ে একটু কথা বলো যাতে করে তুমি তার খোঁজখবর রাখতে পারো। তা না হলে দেখা যাবে সে বাইরে যেয়ে কোন পরপুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে’। তাই সে মেয়েটির সাথে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল,
মেয়েটা ঘরের মধ্য থেকেই কথা বলত; দুজনকেপ্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হতো যেন তারা একজন অন্য জনকে শুনতে পায়।

শয়তান এবার তাকে বলল, ‘তুমি এরকম দূর থেকে একজন আরেকজনের উপর চিৎকার না করে কেন ব্যাপারটাকে নিজের জন্য আরেকটু সুবিধাজনক করে নিচ্ছনা? কেন তার সাথে একই ঘরে বসে কথা বলছ না?’ তো এবার সে মেয়েটার সাথে একই ঘরে বসে কিছুসময় ব্যয় করতে শুরু করল।
তারপর ধীরে ধীরে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসাথে কাটাতে লাগল,আর আস্তে আস্তে তারা পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসতে লাগল। এক সময় এমন হল যখন সেই আবিদ,ধর্মযাজক,উপাসক সেই মেয়ের সাথে যিনায় (ব্যাভিচার) লিপ্ত হল। ফলে মেয়েটা অন্তসত্ত্বাহয়ে পড়ল।
কাহিনী এখানেই শেষ নয়।

মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দিল। শয়তান ধর্মযাজকের কাছে এসে বলল, ‘একি করেছ তুমি! তুমি কি জানো যখন ওর ভাইরা ফিরে আসবে তখন কি হবে? তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, এমনকি তুমি যদি এটাও বলো যে – “এটাআমার বাচ্চা না”,তারা তোমাকে বলবে যে “তোমার বাচ্চা না হলেও তুমি তার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলে,
তাই এটা এখন তোমারই দায়ভার।
বাচ্চার বাবা কে আমরা তার পরোয়া করি না, তুমিই এর জন্য দায়ী”। সুতরাং এখনএকটাই উপায়,
তুমি বাচ্চাটাকে মেরে তাকে পুঁতে ফেল’। বারসিসাবলল, ‘এটা কি গোপন থাকবে আমি তার ছেলেকে মেরে ফেলার পরে?’
শয়তান বলল, ‘তোমার কি মনেহয় ও এটাকে গোপনে রাখবে? তুমি যদি এরকম ভাব, তাহলে তুমি মস্ত বড় বোকা’। সে জিজ্ঞেসকরল, ‘তাহলে আমি কি করব?’। শয়তান জবাব দিল, ‘তোমার ঐ মেয়েটাকেও মেরে ফেলা উচিত’।

তাই সে মেয়েটা কে আর বাচ্চাকে মেরে ফেলল, এরপর দুজনকে একই ঘরের নিচে কবর দিয়ে দিল।
ভাইয়েরা একসময় ফিরে আসল,
তারপর জানতে চাইল,‘আমাদের বোন কোথায়?’, সে উত্তরে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, সেঅসুস্থ হয়ে পড়ে এরপর মারা যায়, তাকে ওখানে কবর দেয়া হয়েছে’ এই বলে সেমনগড়া একটা কবর দেখিয়ে দিল তাদেরকে। তারা বলে উঠল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজি’উন’, তারা বোনের জন্য দু’আ করল, আর নিজেদের বাসায় ফিরে গেল।

রাতের বেলা, তিনজনের মাঝে এক ভাই একটা স্বপ্নদেখল, কে তার সেই স্বপ্নে এসেছিল?
শয়তান, সে তাকে বলল, ‘তুমি বারসিসা কে বিশ্বাস করো? তুমি কি তাকে বিশ্বাস করো? সে মিথ্যা বলেছে। সে তোমার বোনের সাথে ব্যাভিচার করেছে,তারপর তাকে আর তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আর এই কথার প্রমাণ হল সে তোমাদেরকে যেখানে সে কবর দেখিয়েছে তোমাদের বোন সেখানে নেই, আছে তার ঘরের পাথরের নিচে’।

তার ঘুম ভেঙ্গে গেল আর সে তার বাকি ভাইদেরকে স্বপ্নের কথা জানাল। তারা বলল, ‘আমরাও তো একই স্বপ্নই দেখেছি, তাহলে এটা নিশ্চয়ই সত্যি’। পরদিন তারা সেই মিথ্যা কবরটা খুড়ল কিন্তুকিছুই পেল না, এরপর তারা তাদের বোনের ঘরে যেয়ে মাটি সরাল তখন দেখতে পেল তার বোনের মৃতদেহসাথে একটা শিশু। তারা যেয়ে বারসিসাকে ধরল, ‘মিথ্যুক! এইসব করেছ তুমি?’ তারা তাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে গেল। এমন সময় শয়তান আসল বারসিসার কাছে, এবারে কিন্তু সে মনের ওয়াসওয়াসা হিসেবে আসেনি, সে আসল মানুষের রূপ ধরে। তাকে বলল, ‘বারসিসা, তুমি কি জানো আমি কে? আমি শয়তান, আমিই সে, যে তোমাকে এতো ঝামেলার মধ্যে ফেলেছি। আর আমিই সেএকজন, যে তোমাকে এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব। আমিই এসব ঘটনা ঘটিয়েছি আর আমারকাছেই আছে এসবের সমাধান। এখন তোমার উপর নির্ভর করে, তুমি যদি মরতে চাও তো ঠিক আছে।তুমি যদি চাও আমি তোমাকে রক্ষা করি, তাহলে আমি করতে পারি’। বারসিসাবলল, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচাও’।

শয়তান বলল, “আমাকে সিজদাহ করো’। বারসিসা শয়তানের প্রতি সিজদাহ করল। কিন্তু শয়তান কি বলল? সে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল’এরপর সে তাকে আর কোনদিন দেখতে পেল না।
বারসিসা শয়তানের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করল, আর এটাই ছিল তার জীবনে করা শেষ কাজ, কারণ এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সুতরাং তার জীবনের শেষ কাজটা তাহলে ছিল- শয়তানকে সিজদাহ করা, সে ছিল সেই উপাসক যে কিনা ছিল সরল পথের উপর, কিন্তু যেহেতু সে সেপথ থেকে বাঁক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিওখুব খুব ছোট্ট একটা বাঁক, প্রথমদিকে যেটাকে একেবারেই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, একটু সুবিধারনামে, দ্বীনের মাসলাহার নামেই সে এগুলো করেছিল। সরলপথ থেকে তার বিচ্যুতির পরিমাপটা ছিল একদমই নগণ্য কিন্তু দেখুন তার শেষ পরিণতি!


বারসিসা ছিল বনী ঈসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক,‘আবিদ’।
তার নিজের মন্দির ছিল আর সেখানে সে একাগ্রভাবে নিজেকে উপাসনায় নিয়োগ করত।
বনী ঈসরাইলের তিন জন পুরুষ জিহাদে যেতে চাচ্ছিল, তাদের একমাত্র বোনকে কোথায় রেখে যাবে বুঝতে পারছিল না।তারা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কোথায় আমরা আমাদের বোনকে রেখে যেতে পারি? তাকে তো আমরা একা ফেলে যেতে পারিনা। কোথায় তাকে রেখে যাওয়া যায়?’ তখন তারা তাদেরকে বলল, ‘তাকে রেখে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে তাকে ঐ উপাসকের কাছে রেখে যাওয়া, সেই-ই সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি, আর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তোমাদের বোনকে তার কাছে রেখে যাও, সে তার খেয়াল রাখবে’। তারা আবিদের নিকট গেল। তাকে সব বর্ণনা করে বলল, ‘এই হল অবস্থা - আমরা জিহাদে যেতে চাই, আপনি কি কষ্ট করে আমাদের বোনকে দেখে রাখতে পারবেন?’ সে বলল, ‘আমি তোমাদের থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। 

আমার কাছ থেকে চলে যাও’। তখন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করল, ‘তুমি তাকে কার কাছে রেখে আসবে? তুমি যদি তার খেয়াল না রাখো তাহলে হয়ত কোন দুষ্ট লোক তার খেয়াল রাখবে, আর তারপর তো তুমি জানোই কী ঘটবে! তুমি কি করে এই ভাল কাজটা তোমার হাতছাড়া করে দিতে পার?’

দেখুন ! শয়তান তাকে ভাল কাজে উৎসাহিত করছে! তো সে তাদেরকে আবার ডেকে এনে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তার খেয়াল রাখব, কিন্তু সে আমার সাথে আমার মন্দিরে থাকতে পারবে না,

আমার আরেকটা বাড়ি আছে সে সেই ঘরে থাকবে’। সে মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি ওখানে থাক, আমি আমার মন্দিরে থাকব’। তো মেয়েটা সেই বাড়িতে একটা ঘরে থাকত, আর সেই ধর্মযাজক তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসে তার নিজের দরজার বাইরে রেখে দিত। সে মেয়েটির বাড়িতে পর্যন্ত যেত না, নিজের দরজার বাইরেই খাবার রেখে দিত আর মেয়েটিকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে খাবার নিয়ে যেতে হত; সে মেয়েটির দিতে তাকিয়ে দেখতে পর্যন্ত ও চাইত না। তখন শয়তান আবার তার কাছে এসে বলল, ‘তুমি করছটা কি? তুমি কি জানো না মেয়েটা যখন তার ঘর থেকে বের হবে আর তোমার মন্দির পর্যন্ত আসবে লোকে তাকে দেখতেপাবে? তোমার উচিত তার দরজায় যেয়ে খাবারটা রেখে আসা।’ সে বলল,‘হ্যাঁ, আসলেই’।

শয়তান কিন্তু তার সাথে সামনা-সামনি কথা বলছেনা,তাকে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। ধর্মযাজক ‘আবিদ তাই এবার খাবার নিয়ে মেয়েটির দরজা পর্যন্ত রেখে আসতে শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল, এরপর শয়তান তাকে বলল, ‘মেয়েটা এখনও তার দরজা খুলছে আর বাইরে বের হয়ে আসছে প্লেট নেয়ার জন্য, কেউ তাকে দেখে ফেলতেপারে, তোমার উচিত প্লেটটা তার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসা’। শয়তান কিনাতাকে বলছে আরো ভাল কাজ করতে! তাই সে খাবারের প্লেটটা ঘরে রাখা আরম্ভ করল, সেখানে রেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। এভাবে আরো কিছুদিন পার হলো। আর ওদিকে জিহাদ চলতে থাকায় ভাইদেরফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছিল। শয়তান আবারো তার কাছে আসল, বলল, ‘আচ্ছা, তুমি তাকে এভাবে একা ছেড়ে দিবে, কেউ তো নেই যে তার দিকে একটু খেয়াল রাখবে, একটু কথা বলবে।

সে যেন জেলখানায় আবদ্ধ হয়ে আছে, কথা বলার কেউ নেই। তুমি কেন ওর দায়িত্ব নিচ্ছ না? ওর সাথে একটু সামাজিকতা বজায় রেখে তো চলতে পার, যেয়ে একটু কথা বলো যাতে করে তুমি তার খোঁজখবর রাখতে পারো। তা না হলে দেখা যাবে সে বাইরে যেয়ে কোন পরপুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে’। তাই সে মেয়েটির সাথে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল, মেয়েটা ঘরের মধ্য থেকেই কথা বলত; দুজনকেপ্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হতো যেন তারা একজন অন্য জনকে শুনতে পায়।

শয়তান এবার তাকে বলল, ‘তুমি এরকম দূর থেকে একজন আরেকজনের উপর চিৎকার না করে কেন ব্যাপারটাকে নিজের জন্য আরেকটু সুবিধাজনক করে নিচ্ছনা? কেন তার সাথে একই ঘরে বসে কথা বলছ না?’ তো এবার সে মেয়েটার সাথে একই ঘরে বসে কিছুসময় ব্যয় করতে শুরু করল।
তারপর ধীরে ধীরে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসাথে কাটাতে লাগল,আর আস্তে আস্তে তারা পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসতে লাগল। এক সময় এমন হল যখন সেই আবিদ,ধর্মযাজক,উপাসক সেই মেয়ের সাথে যিনায় (ব্যাভিচার) লিপ্ত হল। ফলে মেয়েটা অন্তসত্ত্বাহয়ে পড়ল।
কাহিনী এখানেই শেষ নয়।
মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দিল। শয়তান ধর্মযাজকের কাছে এসে বলল, ‘একি করেছ তুমি! তুমি কি জানো যখন ওর ভাইরা ফিরে আসবে তখন কি হবে? তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, এমনকি তুমি যদি এটাও বলো যে – “এটাআমার বাচ্চা না”,তারা তোমাকে বলবে যে “তোমার বাচ্চা না হলেও তুমি তার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলে,
তাই এটা এখন তোমারই দায়ভার।
বাচ্চার বাবা কে আমরা তার পরোয়া করি না, তুমিই এর জন্য দায়ী”। সুতরাং এখনএকটাই উপায়,
তুমি বাচ্চাটাকে মেরে তাকে পুঁতে ফেল’। বারসিসাবলল, ‘এটা কি গোপন থাকবে আমি তার ছেলেকে মেরে ফেলার পরে?’
শয়তান বলল, ‘তোমার কি মনেহয় ও এটাকে গোপনে রাখবে? তুমি যদি এরকম ভাব, তাহলে তুমি মস্ত বড় বোকা’। সে জিজ্ঞেসকরল, ‘তাহলে আমি কি করব?’। শয়তান জবাব দিল, ‘তোমার ঐ মেয়েটাকেও মেরে ফেলা উচিত’।
তাই সে মেয়েটা কে আর বাচ্চাকে মেরে ফেলল, এরপর দুজনকে একই ঘরের নিচে কবর দিয়ে দিল।
ভাইয়েরা একসময় ফিরে আসল,
তারপর জানতে চাইল,‘আমাদের বোন কোথায়?’, সে উত্তরে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, সেঅসুস্থ হয়ে পড়ে এরপর মারা যায়, তাকে ওখানে কবর দেয়া হয়েছে’ এই বলে সেমনগড়া একটা কবর দেখিয়ে দিল তাদেরকে। তারা বলে উঠল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজি’উন’, তারা বোনের জন্য দু’আ করল, আর নিজেদের বাসায় ফিরে গেল।
রাতের বেলা, তিনজনের মাঝে এক ভাই একটা স্বপ্নদেখল, কে তার সেই স্বপ্নে এসেছিল?
শয়তান, সে তাকে বলল, ‘তুমি বারসিসা কে বিশ্বাস করো? তুমি কি তাকে বিশ্বাস করো? সে মিথ্যা বলেছে। সে তোমার বোনের সাথে ব্যাভিচার করেছে,তারপর তাকে আর তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আর এই কথার প্রমাণ হল সে তোমাদেরকে যেখানে সে কবর দেখিয়েছে তোমাদের বোন সেখানে নেই,
আছে তার ঘরের পাথরের নিচে’।
তার ঘুম ভেঙ্গে গেল আর সে তার বাকি ভাইদেরকে স্বপ্নের কথা জানাল। তারা বলল, ‘আমরাও তো একই স্বপ্নই দেখেছি, তাহলে এটা নিশ্চয়ই সত্যি’। পরদিন তারা সেই মিথ্যা কবরটা খুড়ল কিন্তুকিছুই পেল না, এরপর তারা তাদের বোনের ঘরে যেয়ে মাটি সরাল তখন দেখতে পেল তার বোনের মৃতদেহসাথে একটা শিশু। তারা যেয়ে বারসিসাকে ধরল, ‘মিথ্যুক! এইসব করেছ তুমি?’ তারা তাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে গেল। এমন সময় শয়তান আসল বারসিসার কাছে, এবারে কিন্তু সে মনের ওয়াসওয়াসা হিসেবে আসেনি, সে আসল মানুষের রূপ ধরে। তাকে বলল, ‘বারসিসা, তুমি কি জানো আমি কে? আমি শয়তান,

আমিই সে, যে তোমাকে এতো ঝামেলার মধ্যে ফেলেছি। আর আমিই সেএকজন, যে তোমাকে এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব। আমিই এসব ঘটনা ঘটিয়েছি আর আমারকাছেই আছে এসবের সমাধান। এখন তোমার উপর নির্ভর করে, তুমি যদি মরতে চাও তো ঠিক আছে।তুমি যদি চাও আমি তোমাকে রক্ষা করি, তাহলে আমি করতে পারি’। বারসিসাবলল, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচাও’।

শয়তান বলল, “আমাকে সিজদাহ করো’। বারসিসা শয়তানের প্রতি সিজদাহ করল। কিন্তু শয়তান কি বলল? সে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল’এরপর সে তাকে আর কোনদিন দেখতে পেল না।

বারসিসা শয়তানের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করল, আর এটাই ছিল তার জীবনে করা শেষ কাজ, কারণ এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সুতরাং তার জীবনের শেষ কাজটা তাহলে ছিল- শয়তানকে সিজদাহ করা, সে ছিল সেই উপাসক যে কিনা ছিল সরল পথের উপর, কিন্তু যেহেতু সে সেপথ থেকে বাঁক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিওখুব খুব ছোট্ট একটা বাঁক, প্রথমদিকে যেটাকে একেবারেই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, একটু সুবিধারনামে,
দ্বীনের মাসলাহার নামেই সে এগুলো করেছিল। সরলপথ থেকে তার বিচ্যুতির পরিমাপটা ছিল একদমই নগণ্য কিন্তু দেখুন তার শেষ পরিণতি!

খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতকাল

তিনি ১৯ হিজরী সনে রোমানদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী পাঠালেন। সেই বাহিনীতে ছিলেন সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইববে হুজাফাহ আস সাহমী (রাঃ)। রোমান সম্রাট প্রায়ই রাসূল (সঃ) এর সাহাবীদের ঈমান ও বীরত্বের কথা শুনতেন। তাই তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন মুসলিম সৈনিক জীবিত অবস্থায় বন্দী হলে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) কে রোমানরা বন্দী করে এবং সম্রাটের সামনে উপস্থিত করে।

রোমান সম্রাট হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) কে বললেন, “আমি প্রস্তাব করছি তুমি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ কর। যদি তা কর, তাহলে তোমাকে মুক্তি দেব এবং তোমাকে সম্মানিত করবো।”

বন্দী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) খুব দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আফসোস! যেদিকে আপনি আহবান জানাচ্ছেন তার থেকে হাজার বার মৃত্যু আমার অধিক প্রিয়।”

তখন রোমান সম্রাট বললেন, “আমি মনে করি তুমি একজন বুদ্ধিমান লোক। আমার প্রস্তাব মেনে নিলে আমি তোমাকে আমার ক্ষমতার অংশীদার বানাবো, আমার কন্যা তোমার হাতে সমর্পণ করবো এবং আমার এ সাম্রাজ্য তোমাকে ভাগ করে দেব।”

বেড়ী পরিহিত বন্দী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) মৃদু হেসে বললেন, “আল্লাহর কসম! আপনার গোটা সাম্রাজ্য এবং সেই সাথে আরবদের অধিকারে যা কিছু আছে সবই যদি আমাকে দেওয়া হয়, আর বিনিময়ে আমাকে বলা হয় এক পলকের জন্য মুহাম্মদের (সঃ) দ্বীন আমি পরিত্যাগ করি, আমি তা করবো না।”

রোমান সম্রাট বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবো।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আপনার যা খুশী করতে পারেন।”

এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) কে শূলকাষ্ঠে হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে বলা হল। এতে রাজী না হওয়ায় বিশাল এক কড়াই এনে তাতে তেল ফুটানো হল। টগবগে সেই উত্তপ্ত তেলে ফেলা হল একজন মুসলিম বন্দীকে। ফেলার সাথে সাথে দেহের গোশত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে হাড় পৃথক হয়ে গেল।

সেটা দেখিয়ে এবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) কে আবারও খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের আহবান জানানো হল। এবারও তিনি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। সম্রাটের নির্দেশে তাকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের নিকট আনা হয়। এতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) এর চোখে পানি চলে আসে।

এতে তার মন পরিবর্তন হয়েছে মনে করে সম্রাট তাকে আবারও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে বললেন। কিন্তু তিনি তা আবারও প্রত্যাখ্যান করেন। তাহলে কাঁদছ কেন জিজ্ঞেস করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ (রাঃ) বলেন, “আমি একথা চিন্তা করে কাঁদছি যে, এখনই আমাকে এই কড়াইয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে এবং আমি শেষ হয়ে যাব। অথচ আমার বাসনা, আমার দেহের পশমের সমসংখ্যক জীবন যদি আমার হতো এবং সবগুলিই আল্লাহর রাস্তায় এই কড়াইয়ের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারতাম।” সত্যিই আল্লাহর রাসূল (সঃ) এর সাহাবীদের ঈমান ছিল পর্বতের মতো অটল। আল্লাহু আকবার!



মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রাসূল (সঃ) এর সাহাবীদের মতো সুদৃঢ় ঈমান দান করুন। আমীন।

Sunday, September 8, 2019

হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর ইন্তেকাল (সম্পূর্ণ ঘটনা)

হযরত আলী রাঃ,ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে গেছেন ৷ এদিকে হযরত ফাতিমা রাঃআঃ,গায়ে অত্যান্ত জ্বর অবস্থায়৷ ঘরের সমস্ত কাজ, শেষ করেছেন ৷ 

আলী রাঃ, মসজীদ থেকে এসে দেখে, ফাতিমা কাঁদতেছেন, আলী (রাঃ),প্রশ্ন করলেন,ও ফাতিমা তুমি কাঁদ কেন? ফাতিমা কোন উত্তর দিলেন না৷ ফাতিমা আরোজোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন, আলী রাঃ কয়েকবার প্রশ্ন করার পরে, ফাতিমা রাঃ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 

ও আলী,,,,,,,,আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখতেছি,আমার আব্বাজান, হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ সাঃ আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে কি যেন তালাশ করতেছেন ঘর থেকে বাহির হওয়ার সময়, আমি পিছন দিক থেকে,আমার আব্বাজান কে ডাক দিলাম৷ ও আব্বাজান আপনি কি তালাশ করতেছেন? আব্বাজান
মুহাম্মাদুর রা:(সঃ) বলতেছেন, ও আমার ফাতিমা, আমিতো তোমাকে তালাশ করতেছি, তোমাকে
নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ আরো বললেনঃ ও আমার ফাতিমা,আজকে তো তুমি রোজা রাখবা ৷ 

সাহরী করবা আলীর দস্তরখানায়, আর ইফতার করবা আমি আব্বাজানের দস্তরখানায় ৷৷৷ আলী (রাঃ) এই স্বপ্ন শোনার পর, দু’জনের বুঝতে বাকী থাকলোনা, যে ফাতিমা আজকেই ইন্তেকাল করবেন৷ দুনো জন আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন৷ এই সময়ের মধ্যে হযরত হাসান হুসাইন (রাঃ) এসে জিজ্ঞাসা করতেছেন, ও আব্বাজান ও আম্মাজান আপনারা দুনোজন কাঁদেন কেন? ফাতিমার রাঃ এর একটা অভ্যাস ছিল, যখন হাসান হুসাইন রাঃ কোন কাজে বিরক্ত করতেন, তখন দুনো জনকে নানাজান এর কবরের কাছে যেতে বলতেন।

 আজকে ও ফাতিমা বলেন,তোমরা দুনোভাই এখন নানার কবরে চলে যাও, কবরের নিকট যাওয়ার সাথে সাথে,কবর থেকে আওয়াজ আসলো,ও আমার আদরের নাতীরা, এই মূহুর্তে তোমরা আমার কাছে কেন আসছো, আমার কাছে তো সব সময় আসতে পারবা, এখন যাও, যেয়ে মায়ের চেহারার দিকে তাকায়ে থাক, আজকের পরে তোমাদের মাকে আর পাবেনা৷

এই কথা শোনার পরে,দুনো ভাই কাঁদতেছে আর দৌড়াতে দৌড়াতে আম্মার নিকট চলে গেলেন।
যেয়ে আম্মাকে বললেন যে, তোমরা দুনোজন কেন কাঁদতেছ বুঝেছি, নানাজান আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, আজকের দিনটা তোমার জন্য শেষ দিন, নানাজান তোমার চেহারার দিকে তাঁকায়ে থাকার জন্য আমাদের কে বলেছেন৷ বিকেলের দিকে হজরত ফাতিমা (রাঃ) এর শরীর বেশি খারাপ হলো। তাকে বিছানাতে শোয়ানো হলো। ফাতিমা রাঃ মৃত্যুর পূর্বক্ষনে আলী রাঃ কে, তিনটি কথা বলেন ৷

【০১】ও আলী যেদিন থেকে আমি আপনার ঘরে এসেছি, ঐ দিন থেকে নিয়ে, আজ পর্যন্ত আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি, আলী আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে কিয়ামতের ময়দানে, আমি সন্তানের কারনে, (আমি মেয়ের কারনে) আমার আব্বাজান অনেক লজ্জীত হবেন৷ বলেন আপনি আমাকে ক্ষমা করলেন কি না,আলী রাঃ বলেন ও ফাতিমা, তুমি এসব কি বলতেছো, আমি আলী তো তোমার যোগ্য ছিলাম না, তোমার আব্বাজান দয়া করে মেহেরবানী করে তোমাকে আমার,,, কাছে বিয়ে দিয়েছেন,বিয়ের দিন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত, আমি আলী তোমাকে কোনদিন
ঠিকমত দুইবেলা খানা খাওয়াতে পারিনাই, ও ফাতিমা তুমি বল, আমাকে ক্ষমা করছো কি না, তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর, তাহলে আমাকে ও কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে ৷

【০২】ও আলী আপনার সাথে আমার দ্বিতীয় কথা হল, আমি মারা যাওয়ার পরে, আপনি বিয়েকরে নিবেন, দুনিয়ার যে কোন মহিলাকে, আপনার পছন্দমত৷ আপনাকে আমি অনুমতি দিলাম৷ আর
আমার বাচ্চা দুইটাকে, সপ্তাহে একটা দিন আপনার কোলের মধ্যে করে নিয়ে ঘুমাবেন৷৷

【০৩】ও আলী আপনার সাথে আমার তৃতীয় কথা হল, হাসান হুসাইন যখন বালেগ হবে,তখন দুনো
ভাইকে আল্লাহর রাস্তায় সপর্দ করে দিবেন৷ এবং আমাকে রাতের বেলায় দাফন করবেন।
হজরত আলী (রাঃ) বললেনঃ "তুমি নবীর মেয়ে। আমি সবখানে খবর দিয়ে তোমায় দাফন করবো।
এতে সমস্যা কি? হজরত ফাতিমা (রাঃ) বললেনঃ "আামার কাফনের কাপড়ের ওপর দিয়ে সবাই অণুমান করবে যে, নবীর মেয়ে কতটুকু লম্বা ছিলো, কতটুকু সাস্হ ছিলো। এতে আমার পর্দা ভঙ্গ হবে।" হজরত ফাতিমা (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর তাঁর লাশের খাটিয়া বহন করার মানুষ মাত্র তিনজন। হজরত আলী (রাঃ) এবং শিশু হাসান ও হোসাইন (রাঃ)আনহুমা ৷ হজরত আলী ভাবছিলেন
যে, খাটিয়া বহন করার জন্য মানুষ আরও একজন প্রয়োজন তবেই চার কোনায় চার জন কাঁধে নিতে পারবেন। এমন সময় হজরত আবু জর গিফারী (রাঃ) এলেন ও খাটিয়ার এক কোনা বহন করলেন। হজরত আলী প্রশ্নকরলেন, ও আবুজর আমি তো কাউকে বলিনাই, আপনি জানলেন কিভাবে ? হজরত আবু জর গিফারী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসুল (সঃ) কে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি বললেন,
হে আবু জর! আমার ফাতিমার লাশ বহন করার জন্য লোকের অভাব, তুমি তাড়া তাড়ি চলে যাও। ও
আলী আমাকে তো হুজুরে আকরাম সঃ আসতে বলছেন ৷ হযরত ফাতিমা রাঃ আনহা কে যখন কবরে
নামাচ্ছেন, তখন হজরত আবু জর গিফারী (রাঃ) কবরের কাছে গিয়ে কবর কে উদ্দেশ্য করে বললেন..

আতাদরী মানিল্লাতী জি'না বিহা ইলায়কা?
হে কবর, তুই কি জানিস, আজ
তোর মধ্যে কাকে রাখছি?

【০১】
হা-যিহী সায়্যিদাতু নিসায়ী আহলিল জান্নাতী ফা-তিমাতা রাঃ আনহা, এটা জান্নাতের সকল মহিলাদের সর্দার,ফাতিমা (রাঃ)আনহা৷ কবর থেকে কোন আওয়াজ নাই৷

【০২】
হা-যিহী উম্মূল হাসনাইন রাঃ আনহুমা , এটা হযরত হাসান হুসাইন এর আম্মা ৷

.....এবার ও কবর থেকে কোন আওয়াজ নাই৷

【০৩】
হা-যিহী ঝাউযাতু আলিয়্যিন কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহ্, এটা হযরত আলী রাঃ এর স্ত্রী ৷

......এবার ও কবর থেকে কোন আওয়াজ নাই৷

【০৪【
হা-যিহী বিনতু রসুলুল্লাহি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এটা,দো জাহানের বাদশাহের মেয়ে।
 খবরদার কবর বেয়াদবী করবি না "

"আল্লাহ্ তায়ালা কবরের জবান খুলে দিলেন, কবর
বললঃ

【০১】আনা বায়তুয-যুলমাতি
আমি অন্ধকার ঘর৷

【০২】আনা বায়তুদ-দূদাতী,
আমি সাপ বিচ্ছ্যুর ঘর৷

【০৩】আনা বায়তুন-নফরাতী,
আমি এমন একটি ঘর,
যার মধ্যে কোন বংশ পরিচয় কাজ হয়না...…

"আমি দো জাহানের বাদশাহের মেয়ে
ফাতিমা কে চিনিনা,
হজরত আলীর স্ত্রীকে চিনিনা,
হাসান হোসাইনের আম্মাকে চিনিনা,
জান্নাতের মহিলাদের সর্দারনীকে চিনিনা,

আমি শুধু চিনি-
ঈমান আর আমল!

Thursday, September 5, 2019

হযরত হাসান বসরী (রহঃ)-এর ঘটনা

হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছাকাফী যখন ইরাকের ক্ষমতাভার গ্রহণ করলেন এবং সীমালঙ্গন ও স্বৈরাচারী কাজ শুরু করলেন, তখন হাসান বসরী (রহঃ) সেই অল্পসংখ্যক লোকদের একজন ছিলেন, যারা তার সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিলেন; বলিষ্ঠভাবে মানুষের মাঝে তাঁর অপর্কমের ঘোষণা করেছিলেন এবং সত্যের বাণীকে তাঁর মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন।

হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ একটি প্রাসাদ নির্মাণের পর লোকদের মাঝে এই মর্মে ঘোষণা করলেন, তাঁরা যেন তাঁর প্রাসাদের দীর্ঘস্থায়িত্বের এবং বরকতের দু’আ করে। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) লোকদের এই সমবেত হওয়ার সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলেন, তাঁদের উপদেশ দেয়ার জন্য তাঁদেরকে বোঝানোর জন্য এবং পার্থিব সম্পদের ব্যাপারে তাঁদের উদাসীন করার জন্য ও পরলৌকিক সম্পদের ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ জন্মানোর জন্য।

লোকজন হাজ্জাজের আকাশচুম্বী প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করছে। প্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। প্রাসাদের চাকচিক্যের পূর্ণতা দেখে থমকে যাচ্ছে। তখন তিনি তাঁদের মাঝে বক্তব্য রাখার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালেন, যার সারাংশ হল—

‘যদি আমরা সর্বাদিক নিকৃষ্ট ব্যক্তির তৈরি করা প্রাসাদের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাই, ফেরাউন এর চেয়ে কঠিন মজবুত এবং আকাশচুম্বী উঁচু প্রাসাদ তৈরি করেছিল।’ তারপর আল্লাহ তা’আলা ফেরাউনকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং তাঁর আকাশছোঁয়া প্রাসাদকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন।

হাজ্জাজ যদি বুঝতে পারত যে, আকাশের অধিবাসীরা তাঁকে অপছন্দ করছে এবং পৃথিবীর অধিবাসীরা তাঁর থেকে উপদেশ গ্রহণ করছে। পরদিন হাজ্জাজ যখন তাঁর সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি রাগে ফেটে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর সভাসদদের বললেন—

‘তোমাদের ধ্বংস হোক, তোমরা দূর হও। বসরার এক কৃতদাস উঠে দাঁড়িয়ে তোমাদের সামনে যা ইচ্ছে তা-ই বলল আর তোমাদের মাঝে এমন কেউ ছিল না, যে তাঁকে প্রতিহত করবে অথবা তাঁর কথায় অস্বীকৃতি জানাবে। আল্লাহর কসম করে বলছি, হে কাপুরুষের দল! অবশ্যই আমি তোমাদের তাঁর রক্ত পান করাব।’ তারপর তিনি তরবারী ও নাতা (যে প্রশস্ত চামড়ার বিছানার উপর মানুষের শিরোচ্ছেদ করা হয়) আনার আদেশ করলেন। হাজ্জাজের আদেশমতো তা উপস্থিত করা হলো।

তারপর জল্লাদকে ডেকে হাজ্জাজের সামনে উপস্থিত করা হলো। তারপর হাজ্জাজ হাসানকে ধরে আনার জন্য কয়েকজন সৈন্যকে পাঠালেন। অল্পক্ষণ পরেই হযরত হাসান বসরী (রহঃ) হাজ্জাজের দরবার কক্ষে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এলে সকলের হৃদয়ে কম্পন বেড়ে গেল। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) যখন তরবারী, নাতা ও জল্লাদকে উপস্থিত দেখলেন, তখন তিনি তাঁর ঠোঁটদ্বয় ঈর্ষৎ নাড়ালেন। তারপর হাজ্জাজের দিকে এগিয়ে গেলেন। অথচ তখনও তাঁর সাথে মুমিনের মহিমা, মুসলমানের আত্মসম্মানবোধ এবং আল্লাহর প্রতি আহ্বানকারীর স্থিরতা।

হাজ্জাজ হযরত বসরীর এ অবস্থান দেখে প্রচন্ড ভয়ে বলতে লাগলন, আবু সাঈদ! এদিকে এসো, এখানে বসো। এ কথা বলে তিনি হাসান বসরী (রহঃ) কে বসার জায়গা করে দিচ্ছিলেন। হাজ্জাজের এ অবস্থা দেখে লোকজন বিস্ময় ও হতবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। তারপর হাজ্জাজ ও হযরত হাসান বসরী (রহঃ) উভয়ে নিজ-নিজ আসন গ্রহণ করলেন।

হাসান বসরী (রহঃ) আসন গ্রহণ করলেন এবং তাঁর দিকে তাকালেন এবং ধর্মীয় কিছু বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন আর হযরত হাসান বসরী (রহঃ) তাঁর প্রতিটি প্রশ্নের স্থিরচিত্তে, জাদুকরী ভাষায় এবং প্রগাঢ় জ্ঞানের আলোকে দিতে লাগলেন। হযরত হাসান বসরীর উত্তর শুনে হাজ্জাজ বললেন, হে আবু সাঈদ! আপনি জ্ঞানীদের সম্রাট!! তারপর তিনি সুগন্ধি আনতে বললেন এবং তা হাসান বসরী (রহঃ)-এর দাঁড়িতে মেখে তাঁকে বিদায় জানালেন।

হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বেরিয়ে এলে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের দ্বাররক্ষী তাঁর পিছু-পিছু ছুটে এল এবং বলল, হে আবু সাঈদ! হাজ্জাজ আপনার সাথে যে আচরণ করেছেন, তাঁর বিপরীত আচরণ করার জন্য তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আমি লক্ষ্য করেছি, যখন আপনি অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন আপনি উভয় ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে কী যেন পড়েছিলেন। বলুন তো আপনি কি পড়ছিলেন? হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বললেন, আমি পড়ছিলাম:

‘হে আমার নিয়ামতের অভিভাবক! হে আমার বিপদের আশ্রয়দাতা! আপনি তাঁর ক্রোধকে আমার জন্য শীতল ও শান্তিময় বানিয়ে দিন, যেমনিভাবে আপনি আপনার প্রিয়বন্ধু হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্য আগুন শীতল ও শান্তিময় বানিয়েছিলেন।’’

মেষপালক হিসেবে মুহাম্মাদ (সঃ)

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যখন চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন, তখন তিনি চাচার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায় মেষপাল চরাতেন । প্রায় নবীগণই দেখা যায় প্রথম জীবনে মেষপাল চরানোর কাজ করতেন ।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজেই বলে গেছেন, তিনি কিছু পয়সার বিনিময়ে অন্যলোকেরও মেষ চরাতেন । আমাদের দেশের মেষপালক বালকদের মতো তিনি উন্মুক্ত প্রান্তরে সারাদিন পালাক্রমে মেষ চরাতেন । পরবর্তীকালে যখন তাঁর সাহাবীগণ (সহচর) তাঁকে পাকা জাম এনে দিতেন, তখন তিনি বলতেন পাকা কালো জাম আনতে, কেননা পাকা কালো জাম খেতে সুস্বাদু । এ অভিজ্ঞতাও তাঁর বালক জীবনের ।


মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রথম সিরিয়া যাত্রা

হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর বয়স যখন ১২ বছর তখন আবু তালিব ভাবলেন সিরিয়াতে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে যাত্রা করবেন । পতিমধ্যে নানা বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টের জন্য ভাতিজা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে না নিয়ে যাওয়ার কথাও চিন্তা করলেন । কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ) চাচা আবু তালিবকে এতই ভালোবাসতেন, তিনি তাঁর সঙ্গে যাবেনই । তাই আবু তালিব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে উভয়েই বসরা নামক স্থানে হাজির হলেন । ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই সময়ে বসরায় বুহাইরা নামক এক খ্রীস্টান পাদ্রী
বালক মুহাম্মদ (সঃ)-কে দেখেন । তাঁর দৃষ্টিতে বালক মুহাম্মদ (সঃ)-এর এমন কোন বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে যাতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই বালক একদিন নবীর মর্যাদা লাভ করবেন । 

আবু তালিবকে তিনি সতর্ক করেন, যাতে তিনি এই অসাধারণ বালককে আর কোথাও না নিয়ে যান, কারণ ইহুদীরা এর ক্ষতি করতে পারে । এই ভ্রমণই হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে প্রথম বহির্বিশ্বের স্বাদ আস্বাদন করায়, তিনি বিশ্বের বিরাটত্ব আপন অন্তরে অনুভব করেন । এতদিন তিনি ছিলেন অনুর্বর মক্কার মরুভূমিতে । আজ তিনি শস্য-শ্যামল বসরাতে । তিনি সামুদ গোত্রের রাজত্বভূমি বিরাট প্রান্তর ওয়াদিল কুরাও অতিক্রম করেন । তিনি দেখলেন তাঁদের ধ্বংসাবশেষ । পরবর্তীকালে পবিত্র কোরআনে যার বর্ণনাও আছে । হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর বয়স যদিও তখন ১২ বছর, কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রসারতা ও গভীরতা আকাশের মতো বড় ও সমুদ্রের মতো বিশাল হয়ে উঠেছিল । এবারের বাণিজ্য যাত্রায় আবু তালিব আশাতীত লাভবান হয়েছিলেন । এই বাণিজ্যযাত্রা এত সুখকর ছিল যে, সারা জীবন তিনি তা ভোলেননি ।

Wednesday, September 4, 2019

স্ত্রীর বিস্বাসে তওবা করে ইসলাম গ্রহণ করলেন মুনাফেক স্বামী




এক মহিলার স্বামী ছিল মুনাফেক । সে মহিলার অভ্যাস ছিল প্রতিটি জিনিসের পূর্বে সে "বিসমিল্লাহ" পড়তো, হউক

তা কাজ বা কথা । একদিন তার স্বামী বলল (মনে মনে চিন্তা করল) , আমি এমন একটি কাজ করব যা দ্বারা আমি তাকে "বিসমিল্লাহ" বলার ক্ষেত্রে লজ্জিত করবো । অতএব, তার কাছে একটি থলে দিল এবং তাকে বলল , তুমি এটাকে হেফাজত করে রাখ ।

ঐ মহিলাটি "বিসমিল্লাহ" বলে থলেটি কে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলো, সুযোগ বুঝে এক সময় তার স্বামী থলেটি নিয়ে নিল এবং থলেটিকে তার বাড়ির কূপে ফেলে দিল । অতঃপর স্ত্রীর নিকট


এসে থলেটি ফেরত চাইল । মহিলাটি যথাস্থানে এসে "বিসমিল্লাহ" বলে হাত বাড়িয়ে দিল । আল্লাহ তায়ালা তখন ঐ "বিসমিল্লাহ"বলার বদৌলতে মহিলাকে যাতে অপমানিত হতে না হয় হযরত জিবরাঈল (আঃ) তে তৎক্ষণাৎ অবতরণের আদেশ প্রদান করলেন এবং থলেটিকে তার স্থানে পূর্বের ন্যায় রেখে দিতে বললেন ।


অবশেষে সে তা যেভাবে রেখেছে সে ভাবেই পেল । তার স্বামী আশ্চর্যান্বিত হয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করে ক্ষমা চাইল। কিতাবুল কালয়ুবি ঘটনা নং ১১ পৃষ্ঠা নং ৪৫ সুবাহানাল্লাহ ( মহান আল্লাহ্ কত মেহের বান দেখেছেন আল্লাহ কখন তার বান্দাহদের অন্যায় ভাবে অযথা অপমানিত হতে দেন না।) রাসূল (সাঃ) এর উম্মাতি হিসেবে এই লেখাটা শেয়ার করতে ভুলবেন না ।

আবূ ত্বালিবের মৃত্যুর ঘটনা

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব তার পিতা মুসাইয়্যাব (রহঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, যখন আবূ ত্বালিব মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হ’লেন, রাসূল (সাঃ) তার নিকট গেলেন।আবূ জাহলও সেখানে ছিল। নবী (সাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজান! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ -কালেমাটি একবার পড়ুন, তাহ’লে আমি আপনার জন্য আল্লাহ্‌ নিকট কথা বলতে পারব।

তখন আবূ জাহল ও আব্দুললাহ ইবনু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ ত্বালিব! তুমি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম হ’তে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ ত্বালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তা হ’ল, আমি আব্দুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী (সাঃ) বললেন, ‘আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়’।এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি নাযিল হল: ‘নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকটাত্মীয়ও হয়, তবুও যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী’ [সূরা তওবা – ১১৩]

আরো নাযিল হল: ‘আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে হিদায়াত করতে পারবেন না’ [সূরা কাছাছ – ৫৬]

[ বুখারী হা/৩৮৮৪ ‘আনছারদের মর্যাদা’অধ্যায়, ‘আবু ত্বালিবের কাহিনী’অনুচেছদ ]

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রা:) হ’তে বর্ণিত যে, তিনি নবী (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, যখন তাঁর সামনে তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবের আলোচনা করা হ’ল, তখন তিনি বললেন, আশা করি কিয়ামতের দিনে আমার সুফারিশ তার উপকারে আসবে। অর্থাৎ আগুনের হালকা স্তরে তাকে ফেলা হবে। যা তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাবে আর এতে তার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে (ঐ, হা/৩৮৮৫)।
শিক্ষা:

১. হেদায়েতের মালিক আল্লাহ্‌ তা‘আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন, যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। এজন্য সবসময় তার কাছে হেদায়েত চাইতে হবে।
২. জাহান্নামের আযাব অত্যন্ত ভয়াবহ।সবচেয়ে হালকা শাস্তি হওয়ার পরেও যদি আবূ ত্বালিবের এই অবস্থা হয়, তাহ’লে অন্যদের কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
৩. সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষকে অনেক সময় হক গ্রহণ থেকে বিমুখ রাখে।

খলিফা হারুনুর-রশিদের একটি অসাধারণ ঘটনা

খলিফা হারুনুর-রশিদের নিকট 'রাকা' নামের একটি শহর থেকে চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিল: শহরের বিচারক এক মাস যাবত অসুস্থ,বিচার কাজ স্থগিত হয়ে আছে । খলিফা যেন দ্রুত ব্যবস্থা করেন । খলিফা চিঠির জবাব পাঠালেন । আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক আসবেন । এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক এসে যোগ দিলেন ।

বিচার কাজ শুরু হয়েছে । স্থানীয় প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে দরবারে হাজির করলেন । তার অপরাধ ছিল তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পরেন ।

বিচারক: আপনি চুরি করেছেন?
– জ্বি ।
– আপনি কি জানেন চুরি করা কতো বড় অপরাধ ও পাপ ?
– জ্বি ।
– জেনেও কেন চুরি করলেন ?
– কারণ আমি গত এক সপ্তাহ যাবত অনাহারে ছিলাম । আমার সাথে এতিম দু’নাতিও না খেয়ে ছিল । ওদের ক্ষুদারত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে পারিনি তাই চুরি করেছি। আমার আর এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না হুজুর ।

বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখবুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য,শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিগন সবাই উপস্থিত থাকেন ।তখন এর রায় দেওয়া হবে ।

পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন । বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন-“ বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো। বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশাপাশি দাঁড়ালেন ।

বিচারক বললেন যে নগরে একজন ক্ষুধার্তবৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয় সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে । আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হউক । আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ । আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।
বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন । দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে । ঐ অবস্থায় বিচারক পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন । কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করেন। এরপর বিচারক বললেন “ যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাব গ্রস্হ মহিলার ভরন-পোষণ করতে পারেন না। সেই নগরে তারা ও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমান ভাবে তাদেরকে মারা হোক ।“

এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন । তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন “যে সমাজ একজন বৃদ্ধমহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী । তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।“
এবার মোট ৫০০দিনার রৌপ্য মুদ্রাথেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানাবাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বললেন “ এগুলো আপনার ভরণপোষণের জন্য । আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুনুর রশিদের দরবারে আসবেন । খলিফা হারুনুর রশিদ আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী ।

“একমাস পরে বৃদ্ধা খলীফার দরবারে গিয়ে দেখেন ; খলীফার আসনে বসা লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে । মহিলা ভয়ে ভয়ে খলীফার আসনের দিকে এগিয়ে যান। কাছে গিয়েবুঝতে পারেন লোকটি সেদিনের সেই বিচারক। খলীফা চেয়ার থেকে নেমেএসে বললেন —আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম । আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকারসমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য ।আপনি দয়াকরে আমাকে ক্ষমা করুন ।

Tuesday, September 3, 2019

আবু হোরায়রা (রাঃ) এর একটি শিক্ষণীয় গল্প

একদিন হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর নিকট এসে কাঁদছেন। রাসুল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, "হে আবু হোরায়রা তুমি কেন কাঁদছ?" হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বললেন, আমার মা
আমাকে মেরেছেন। রাসুল (সাঃ) বললেন, "কেন তুমি কি কোন বেয়াদবী করেছ?" হযরত আবু হোরায়রা ( রাঃ ) বললেন, না হুজুর কোন বেয়াদবী করিনি। আপনার দরবার হতে বাড়ি যেতে আমার
রাত হয়েছিল বিধায় আমার মা আমাকে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি আপনার কথা বললাম। আরআপনার কথা শুনে মা রাগে আমাকে মারধর করল আর বলল, হয়ত আমার বাড়ি ছাড়বি আর না
হয় মুহাম্মদ (সাঃ) এর দরবার ছাড়বি।

আমি বললাম, ও আমার মা। তুমি বয়স্ক মানুষ। তোমার গায়ে যত শক্তি আছে তত শক্তি দিয়ে মারতে থাকো। মারতে মারতে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দাও। তবুও আমি আমার রাসুলুল্লাহ্ ﷺ কে ছাড়তে পারবো না। তখন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমার মা তোমাকে বের করে দিয়েছেন আর এজন্য আমার কাছে নালিশ করতে এসেছ? আমার তো এখানে কিছুই করার নেই। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বললেন, হে রাসূল (সাঃ) আমি আমার মায়ের জন্য এখানে নালিশ করতে আসি নাই।

রাসুল (সাঃ) বললেন, তাহলে কেন এসেছ? হযরত আবু হোরায়রা( রাঃ ) বললেন, আমি জানি আপনি আল্লাহর নবী ( সাঃ)। আপনি যদি হাত উঠিয়ে আমার মায়ের জন্য দোয়া করতেন, যাতে আমার মাকে যেন আল্লাহ হেদায়েত করেন। আর তখনই সাথে সাথে রাসুল (সাঃ) হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, "হে আল্লাহ! আমি দোয়া করি আপনি আবু হোরায়রার আম্মাকে হেদায়েত করে দেন।”

রাসুল (সাঃ) দোয়া করলেন আর আবু হোরায়রা বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। পিছন থেকে কয়েকজন লোক আবু হোরায়রার জামা টেনে ধরল এবং বললো, হে আবু হোরায়রা! তুমি দৌড়াচ্ছ কেন? তখন হযরত আবু হোরায়রা ( রাঃ ) বললেন, ওহে সাহাবীগণ তোমরা আমার জামা ছেড়ে দাও।আমাকে দৌড়াতে দাও। আমি দৌড়াইতেছি এই কারণে যে, আমি আগে পৌঁছলাম নাকি আমার নবীজির দোয়া আগে পৌঁছে গেছে। হযরত আবু হোরায়রা ( রাঃ ) দরজায় ধাক্কাতে লাগলো। ভিতর থেকে তার মা যখন দরজা খুললো তখন হযরত আবু হোরায়রা দেখলেন তার মার সাদা চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। তখন মা আমাকে বললেন, হে আবু হোরায়রা! তোমাকে মারার পর আমি বড় অনুতপ্ত হয়েছি, অনুশোচনা করেছি।

মনে মনে ভাবলাম আমার ছেলে তো কোন খারাপ জায়গায় যায়নি। কেন তাকে মারলাম? আমি বরং লজ্জায় পড়েছি তোমাকে মেরে। হে আবু হোরায়রা! আমি গোসল করেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি রাসুল (সাঃ) এর দরবারে নিয়ে চল। আর তখনই সাথে সাথে আবু হোরায়রা তার মাকে রাসুল (সাঃ) এর
দরবারে নিয়ে গেলেন। আর তার মাকে সেখানেই # পবিত্র_কালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।

হযরত আলী (রা:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

হযরত আলী (রা:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর চাচাত ভাই ও জামাতা এবং চতুর্থ খলীফা হচ্ছেন হযরত আলী (রাঃ)। তার পিতা আবু তালিব ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের পুত্র । আলী (রাঃ) এর ডাক নাম আবু তুরাব, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর নিকট হইতে প্রাপ্ত । তিনি হযরত (সঃ) এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ) কে বিবাহ করেন । তাঁহার মাতার নাম ফাতেমা বিনতে আসাদ ইবন হাশিম । ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁহার বয়স কত ছিল তাহা সঠিকরূপে নির্ধারন করা যায় না ।

হযরত খাদীজা (রাঃ) এর পরে তিনি প্রথম মুসলিম; আবুযার, আল মিকদাদ, আবু সাইদ আল খুদরী (রাঃ) প্রমুখের মতে বুরায়দা ইবনিল হুসায়ব (রাঃ) অথবা তিনি দ্বিতীয় মুসলিম । হযরত (সঃ) যে দশজনকে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করিবেন বলিয়া স্পষ্টভাবে সুসংবাদ প্রদান করেন, তিনি তাহাদের অন্যতম । উমার (রাঃ) কর্তৃক তাঁহার মৃত্যুশয্যায় মনোনীত ছয়জন নির্বাচকেরও তিনি ছিলেন অন্যতম ।

এক নজরে হযরত আলি (রাঃ)

পূর্ণ নাম : আলী ইবনে আবু তালিব

জন্মঃ অক্টোবর ২৩, ৫৯৮// মার্চ ১৭, ৫৯৯ // মার্চ ১৭, ৬০০ (একেক জায়গায় একেক রকমের দেওয়া, তাই তিনটাই উল্লেখ করলাম)

পিতাঃ আবু তালিব

মাতাঃ ফাতিমা বিনতে আসাদ

স্ত্রীঃ হযরত ফাতিমা (রাঃ)

সন্তানঃ ইমাম হাসান , ইমাম হোসাইন, জয়নাব

রাজত্বকাল : ৬৫৬–৬৬১

পূর্বসূরীঃ হযরত ওসমান (রাঃ)

উত্তরসূরীঃ ইমাম হাসান (রাঃ)

মৃত্যুঃ জানুয়ারি ২৮, ৬৬১

প্রাথমিক জীবন

হযরত আলী (রাঃ) এর বয়ছ ছিল তখন প্রায় বাইশ বছর । আল্লাহ্‌ তা’আলার নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইয়াছরিবে হিজরত করার শেষ রাতে শত্রুদের চোখের সামনে দিয়া নিরাপদে গৃহ ত্যাগ করিলেন । যাবার সময় হযরত আলী (রাঃ) কে আমানতের গচ্ছিত সম্পদ প্রদানের দায়িত্ব দিয়া গেলেন । প্রত্যুষে শত্রুপক্ষ দেখিল, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিছানায় শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) নিশ্চিন্ত মনে শুইয়া আছে ।

হিজরাতের দ্বিতীয় বর্ষে হযরত (সঃ) এর প্রিয় কন্যা ফাতেমা (রাঃ) এর সহিত আলী (রাঃ) এর বিবাহ সম্পন্ন হয় । বিবাহের সময় হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বয়স ছিল ১৪ বছর এবং হযরত আলী (রাঃ) এর বয়স ছিল ২২ বছর । (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, এসাবা, খোলাফায়ে রাশেদিন) । তিনি বদর, উহুদ ও খন্দক(পরিখা) এর যুদ্ধে যোগদান এবং তাবূক ছাড়া অন্য সমস্ত অভিযানে হযরত (সঃ) এর সঙ্গে গমন করেন । তাবূক অভিযানের সময় হযরত (সঃ) এর অনুপস্থিতিতে তাঁহার পরিবার-বর্গের তত্ত্বাবধান এবং মদিনার শাসনভার তাঁহার উপর ন্যস্ত ছিল । উহুদের যুদ্ধে তিনি ষোলটি আঘাতপ্রাপ্ত হন; তাঁহার প্রচণ্ড আক্রমণে খায়বারের দুর্জয় কা’মূস দূর্গের পতন ঘটে ।

হযরত (সঃ) এর উপর নবম সূরা (আল বারা’আঃ বা আত-তাওবা) অবতীর্ন হওয়ার অল্প পরে উহার প্রথম তেরটি আয়াত হাজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করার জন্য হযরত (সঃ) তাহাকে প্রেরণ করেন । দশম হিজরি, মুতাবিক ৬৩১-৩২ সনে আলী (রাঃ) ইয়ামানে এ প্রচার সফরে গমন করেন । ইহারই ফলে হামাদানীরা ইসলাম গ্রহণ করে । এ বছরই রাসুল (সঃ) হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কাশরীফ গমন করেন ; হজ্জ হতে ফেরার পথে তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর হাত ধরিয়া ফরমাইলেন “আমি যাহার মওলা হই, ইনিও অর্থাৎ হযরত আলী (রাঃ)ও তাঁহার মওলা ।”

এলেমের দরজা

রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হইয়াছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মুখে যিনি কোরআন পাক শ্রবণ করিয়াছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছেই যিনি কুরআন শিক্ষা লাভ করিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন, তাঁহার এলম সম্পর্কে আর কাহার এলেমের তুলনা করা যাইতে পারে ? রাসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেনঃ “আমি এলেমের শহর এবং আলী উহার দরজা ।“ এই কাড়নের সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যান্য সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ।

খলিফা নির্বাচন

হযরত উসমানের (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর মদিনাতে একটি সর্বব্যাপী বিশৃংখলা এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছিল।পাঁচ দিন যাবত রাজনৈতিক ডামাডোলের পর, মিসরীয় বিদ্রোহীদের নেতা, ইবনে সাবা, হযরত আলী (রাঃ)-এর পক্ষে এই বলে রায় দেয় যে, তিনিই একমাত্র খলিফা হওয়ার অধিকারী কারণ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যার সপক্ষে একটি ওসিয়্যত করেছিলেন।২৩শে জুন ৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে, হযরত উসমানের (রাঃ) মৃত্যুর ছয় দিন পর, হযরত আলী (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন এবং জনগণ তাঁর হাতে একে একে বয়'আত গ্রহণ করেন।।

হযরত আলি (রাঃ) এর শাসনকাল

খেলাফতের নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদীনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান।তাঁর নির্বাচনের পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে মহানবী (সাঃ) এর প্রভাবশালী সাহাবী যেমন হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর উত্থাপিত 'হযরত উসমান(রাঃ)-এর হত্যাকারীদের যথাশীঘ্র শাস্তির জনপ্রিয় দাবীর সম্মুখিন হন। হযরত আলী(রাঃ) ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি- শৃংখলা পুনঃস্থাপন করা এবং কেবল তারপরই তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখিন করতে পারবেন। কিন্তু হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ), হযরত আলী(রাঃ) এর এই সিদ্ধান্তে রাজী হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ), যিনি প্রকৃত অবস্থা অবগত ছিলেন না, তিনিও হযরত উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর সাথে যোগ দেন। তিনজনে মিলে বসরার উদ্দেশ্যে এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।হযরত আলী (রাঃ) যুদ্ধ এবং রক্তপাত এড়াতে যারপরনাই চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, তাঁর এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, যদিও, হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধের পূর্বেই সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং অন্য কোন শত্রুর দ্বারা নিহত হন।

হযরত আয়েশার (রাঃ) সৈন্যরা পরাজিত হয় কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাঁর নিরাপত্তার খেয়াল রাখেন। তিনি তাঁর ভাই মোহাম্মদ বিন আবু বকর (রাঃ) এর রক্ষাবেষ্টনীতে তাঁকে মদীনায় প্রেরণ করেন। এটি 'উটের যুদ্ধ' নামে খ্যাত; কারণ হযরত আয়েশা(রাঃ) যুদ্ধের সময় উটের উপর সওয়ারী ছিলেন। পরবর্তীতে, হযরত আয়েশা (রাঃ) জীবনভর হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অনুতপ্তা ছিলেন।উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কে, যিনি তখনও তাঁর হাতে বয়'আত গ্রহণ করেননি, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর নিকট আত্বসমর্পণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এই অজুহাতে তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পণ করেনি যে, হযরত উসমান(রাঃ) যিনি উমাইয়া বংশোদ্ভূত ছিলেন, তার রক্তের প্রতিশোধ প্রথমে নিতে হবে।

আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ), আমর বিন আস (রাঃ) এর সহায়তায়, সৈন্য প্রস্তত করা শুরু করে। হযরত আলী (রাঃ), অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে, মুয়াবিয়ার সাথে লড়ার জন্য সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতে হয়। ৫৬৭ খ্রীস্টাব্দের জুলাই এ দুই সৈন্য বাহিনী 'সিফফিনে' যুদ্ধে উপনীত হয়। দু'পক্ষেই ব্যাপক হতাহত হয়; কিন্তু যুদ্ধ এই মতৈক্যে শেষ হয় যে, বিষয়টি একটি মধ্যস্থতা কমিটিতে নিষ্পত্তি হবে। এই কমিটিতে হযরত আলী (রাঃ) এর পক্ষে আবু মুসা আল আসরি (রাঃ) এবং আমীর মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর বিন আস (রাঃ) প্রতিনিধিত্ব করে। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই মধ্যস্থতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ আমর বিন আস (রাঃ) আবু মুসা আল আসরি (রাঃ)-এর সাথে গ্রহীত সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাড়াঁয়।

একটি বড় দল, যারা মধ্যস্থতার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, হযরত আলী (রাঃ) থেকে সরে গিয়ে তাদের জন্য এক নতুন আমীর নির্বাচিত করে নেয়।এই দলটিকে 'খারেজী' অর্থাৎ'ব্যতান্ত্রিক' বলা হয়ে থাকে। সর্বপ্রথম, হযরত আলী (রাঃ) তাদেরকে বুঝিয়ে রাজি করেনোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তা নিস্ফল হয়; যা ভয়াবহ যুদ্ধে মোড় নিলে প্রচুর খারেজী নিহত হয়।এই বিপর্যস্ত পরাজয়ের পর খারেজীরা হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং আমর বিন আস (রাঃ) কে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তী দু'জন হত্যা প্রচেষ্টা হতে বেঁচে যেতে সক্ষম হলেও হযরত আলী (রাঃ) ফযরের নামাজের জন্য মসজিদে যাবার সময় আক্রমণকারীর দ্বারা গুরুতর আহত হন। দু'দিন পর এই অমিত সাহসী এবং ধর্মপ্রাণ খলীফা ৪০ হিজরীর ২০ রমযানে পরলোক গমন করেন। এই সময়ে তাহার ৩৭ বত্সর বয়সী বড় ছেলে আল হাসানকে (রাঃ) ইমামতি হস্তান্তর করেন৷নিঃসন্দেহে, হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতের পবিত্রতা এবং মর্যাদা রক্ষার খাতিরে তাঁর জীবন কুরবান করেন।তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সাঃ) যাঁদের বেহেস্তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।

মৃত্যুর পূর্বকালীন ঘটনা ও মৃত্যু

মুসলমানরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ ও একে অন্যকে হত্যার নেশায় মেতে ওঠে। ফলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে উষ্ট্রের যুদ্ধ ও ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিফ্ফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৃহযুদ্ধে রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রত্যয়িত তালহা, যুবাইর ও অনেক বয়োবৃদ্ধ সাহাবাসহ লক্ষাধিক মুসলমান নিহত হন। কার্যত ইসলামী খেলাফত অত্যন্ত দ্রুত অন্তিম সময়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

সিফ্ফিনের যুদ্ধের পর 'দুমাতুল জানদালে' ইসলামী খেলাফতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বৈঠককালে ১২ হাজার সৈন্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী খলিফার পক্ষ ত্যাগ করে। ইসলামে 'খারেজি' নামে উগ্রপন্থী সম্প্রদায়ের উদ্ভব তাদের থেকেই।

খারেজি সম্প্রদায় মুসলিম মিল্লাতের জাতীয় শত্রু হিসেবে হজরত আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস (রা.)কে চিহ্নিত করে তাঁদের একই দিন ও অভিন্ন সময়ে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আসন্ন মাহে রমজানের ১৫ তারিখ ফজরের নামাজের সময় আক্রমণ পরিচালনার সময় নির্ধারিত হয়। আততায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে বয়োবৃদ্ধ তিন সাহাবির ওপর হামলা করে।

সৌভাগ্যক্রমে আমর ইবনুল আস (রা.) অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদেই যাননি। আর মুয়াবিয়া (রা.) আততায়ীর আক্রমণে সামান্য আহত হলেও বেঁচে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হজরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন এবং কুফা জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

সরলতা ও আত্দত্যাগের প্রতীক ছিলেন হজরত আলী (রা.)। মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও নিজ হাতে তাঁকে ও ফাতেমা (রা.)কে কাজ করতে হতো। দাস-দাসী কোনো দিনই তাঁর ঘরে ছিল না। ইতিহাসবিদ হিট্টি বলেছেন, 'আলী (রা.) ছিলেন যুদ্ধে সাহসী, পরামর্শদানে বিজ্ঞ, বক্তৃতায় স্বচ্ছ, সাবলীল, বন্ধুদের প্রতি অকপট এবং শত্রুদের প্রতি দয়াশীল। আলী (রা.) মাহাত্দ্য ও শৌর্য-বীর্যের নিদর্শনস্বরূপ ছিলেন।'

মাসুদী বলেন, 'আল্লাহ তাঁহাকে যে গুণাবলি দ্বারা ভূষিত করেন, তাঁহার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী (একমাত্র রাসুলে কারিম ছাড়া) অন্য কারো মধ্যে আমরা খুঁজিয়া পাইব না।' বস্তুত হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে খোলাফায়ে রাশেদিনের সমাপ্তি ঘটে।

অভিভাবকের দায়িত্বে আবু তালিব।

আবদুল মুত্তালিব তাঁর মৃত্যুশয্যায় শিশু মুহাম্মদ (সঃ)-এর অভিভাবকত্বের ভার দিলেন আবু তালিবের ওপর । কেননা আবু আবু তালিব ভাতিজাকে পুত্রের অধিক স্নেহ করতেন । কারণ মুহাম্মদ (সঃ)-এর বুদ্ধিমত্তা, বিবেক, বিবেচনা, বদান্যতা, উদার হৃদয় ও মহত্ত্ব সকলকে অতিক্রম করেছিল । এখন থেকে আবু তালিবই হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পিতা ও মাতা স্বরূপ । হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনে একটা করুণ ইতিহাস যে, আবু তালিব জীবিত অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেননি । কিন্তু সারা জীবন তিনি মুহাম্মদ (সঃ)-কে ছায়ার মতো রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন । একদিনের জন্যও তাদের দু'জনের মধ্যে সম্পর্কের কোনরূপ তিক্ততা দেখা দেয়নি । শুধু আবু তালিব বলে নয়, অন্য যে কোন ধর্মের, এবং যে কোন লোকের সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সম্পর্ক কোনদিনের জন্যই তিক্ত হতো না, শুধু মাত্র কোনরূপ ইসলাম বিদ্বেষী কাজ এবং অসৎ আচরণ ছাড়া । অনেকেরই ধারণা ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ না করাতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতেন । আসলে কিন্তু এটা একেবারেই ভুল ধারণা । যে মানুষের মধ্যে তিনি মনুষ্যত্বের বিকাশ লক্ষ্য করতেন, তাঁকে তিনি সবসময়ই অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন, এবং অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন । তাই আবু তালিব যদিও একজন অমুসলিম ছিলেন, তবুও তাঁদের দু'জনের সম্পর্কে এতোটুকুও মলিনতা আসেনি কখনো ।

হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্পূর্ণ জীবনী



আললাহুম্মা সাললিআলা মুহাম্মাদিঁ ওয়া আলা আলি মুম্মাদিন কামা সাললাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আললাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ।

সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনেরা, আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে হাজির হয়েছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জিবনী নিয়ে । ভুল ট্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করা হল।

(হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্পূর্ণ জীবনী)

**জন্ম**

হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রচলিত ধারনা মোতাবেক, উনার জন্ম ৫৭০ খৃস্টাব্দে। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে ৫৭০ সনই ব্যবহার করেছেন। তবে উনার প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া মুহাম্মদ(সা.)নিজে কোনো মন্তব্য করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি. এজন্যই এ নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি জন্মমাস নিয়েও ব্যপক মতবিরোধ পাওয়া যায় । [৩] যেমন, এক বর্ণনা মতে, উনার জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে শেষোক্ত মতই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য। যাই হোক, নবীর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই।

**শৈশব ও কৈশোর কাল**

তত্কালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে মোহাম্মদকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়। এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য – শিশু মোহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হল। ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে – একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে মোহাম্মদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ ব্ছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননা। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

**নবুয়ত-পূর্ব জীবন**

আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মুহাম্মাদের তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসায় শুরু করেন। মুহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসায় উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।

খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলেন জানাবেন। মুহাম্মাদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। খাদীজার জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননি। খাদীজার গর্ভে মুহাম্মাদের ৬ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে যার মধ্যে ৪ জন মেয়ে এবং ২ জন ছেলে। তাদের নাম যথাক্রমে কাসেম, যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম’, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ। ছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামী যুগ পায় এবং ইসলাম গ্রহণ করে এবং একমাত্র ফাতিমা ব্যতিত সবাই নবীর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করে।

মুহাম্মাদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা’বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মুহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।

**নবুওয়ত প্রাপ্তি**

চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল তাঁকে এই পংক্তি কটি পড়তে বলেন:

“পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না”।

উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাবেন, “আমাকে আবৃত কর”। খাদিজা নবীর সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেন। ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মাদকে নিয়ে খাদিজা নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে যান। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্‌সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলততার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়।

**মক্কী জীবন**


হেরা গুহা, এখানেই মুহাম্মাদ প্রথম প্রত্যাদেশ পান

**গোপন প্রচার**

প্রত্যাদেশ অবতরণের পর নবী বুঝতে পারেন যে, এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে; কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যাতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিলনা। তাই প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন। মুহাম্মাদের আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন খাদিজা। এরপর মুসলিম হন মুহাম্মাদের চাচাতো ভাই এবং তার ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী, ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য নবী নিজ বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন; এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি, এ সভাতে শুধু একজনই ইসলাম গ্রহণ করে, সে হলো আলী। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল নবীর অন্তরঙ্গ বন্ধূ আবু বকর। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এবং এই প্রচারকাজ চলতে থাকে সম্পূর্ণ গোপনে।

**প্রকাশ্য দাওয়াত**

তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরণের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। নবী সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিৎকার করে সকলকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্‌র রাসূল। কিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়।

**মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন**

বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে নির্যাতন শুরু করে: প্রথমত উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি, এরপর অপপ্রচার, কুটতর্ক এবং যুক্তি। এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় যাকে সফল করার জন্য একটি নেতিবাচক ফ্রন্ট গড়ে উঠে। একই সাথে গড়ে তোলা হয় সাহিত্য ও অশ্লীল গান-বাজনার ফ্রন্ট, এমনকি একং পর্যায়ে মুহাম্মাদের সাথে আপোষেরও প্রচেষ্টা চালায় কুরাইশরা। কিন্তু মুহাম্মাদ তা মেনে নেননি; কারণ আপোষের শর্ত ছিল নিজের মত ইসলাম পালন করা, সেক্ষেত্র তার ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতো।

**ইথিওপিয়ায় হিজরত**

ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করে, তখন নবী কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ

এরপর ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। নবী সবসময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করে। তার এই ইচ্ছা এতে পূর্ণতা লাভ করে। আরব সমাজে উমরের বিশেষ প্রভাব থাকায় তার ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারকে খানিকটা সহজ করে, যদিও কঠিন অংশটিই তখনও মুখ্য বলে বিবিচেত হচ্ছিল। এরপর একসময় নবীর চাচা হামযা ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণে আরবে মুসলিমদের আধিপত্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়।

**একঘরে অবস্থা**

এভাবে ইসলাম যখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অনুসারী সহ সহ গোটা বনু হাশেম গোত্রকে একঘরে ও আটক করে। তিন বছর আটক থাকার পর তারা মুক্তি পায়।

**দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন**

কিন্তু মুক্তির পরের বছরটি ছিল মুহাম্মাদের জন্য দুঃখের বছর। কারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিব মারা যায়। দুঃখের সময়ে নবী মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপরে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। হতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান (অবশ্য তায়েফ গমনের তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে)। কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি; নব নব সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।

**মি’রাজ তথা উর্দ্ধারোহন**

এমন সময়েই কিছু শুভ ঘটনা ঘটে। ইসলামী ভাষ্যমতে এ সময় মুহাম্মাদ এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমণ ইতিহাসে ইসরা নামে পরিচিত। কথিত আছে, মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে উর্দ্ধারোহণ করেন এবং মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন, এছাড়া তিনি বেহেশ্‌ত ও দোযখ সহ মহাবিশ্বের সকল স্থান অবলোকন করেন। এই যাত্রা ইতিহাসে মি’রাজ নামে পরিচিত। এই সম্পূর্ণ যাত্রার সময়ে পৃথিবীতে কোন সময়ই অতিবাহিত হয়নি বলে বলা হয়।

**মদীনায় হিজরত**


এরপর আরও শুভ ঘটনা ঘটে। মদীনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল। এরা আকাব নামক স্থানে মুহাম্মাদের কাছে শপথ করে যে তারা যে কোন অবস্থায় নবীকে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। এই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিত। এই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে। এ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারেনা। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যায়। সবশেষে মুহাম্মাদ ও আবু বকর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয়নি। এভাবেই মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে।

**মাদানী জীবন**
নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হত। এটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়। এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষের শেষে AH উল্লেখিত থাকে যার অর্থ: After Hijra।

**স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন**

মুহাম্মাদ মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ। তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন। মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভুতি সৃষ্টি করা হয়। আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির)। এগুলোসহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)হন তার প্রধান।

**মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ**

মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুহাম্মাদ(স)মদীনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঠায়। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। মুসলিমদের মতে এই যুদ্ধে আল্লাহ মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেন। যাহোক, এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটে। এরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। কুরাইশরা বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিতের বেশে মক্কায় প্রবেশ করে। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধ বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে আশেপাশের অনেক গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

**মদীনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক**


কিন্তু এ সময় মদীনার বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়। মূলত ইহুদীরা বিশ্বাস করতনা যে, একজন অ-ইহুদী শেষ নবী হতে পারে। এজন্য তারা কখনই ইসলামের আদর্শ মেনে নেয়নি এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বুঝতে পারে তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)প্রতিটি যুদ্ধের পরে একটি করে ইহুদী গোত্রের উপর আক্রমণ করেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্র সপরিবারে মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়; আর খন্দকের পর সকল ইহুদীকে মদীনা থেকে বিতাড়ন করা হয়।[৫] মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এই ইহুদী বিদ্বেশের দুটি কারণের উল্লেখ পাওয়া যায়, একটি ধর্মীয় এবং অন্যটি রাজনৈতিক[৬]। ধর্মীয় দিক দিয়ে চিন্তা করলে আহলে কিতাব হয়েও শেষ নবীকে মেনে না নেয়ার শাস্তি ছিল এটি। আর রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করলে, ইহুদীরা মদীনার জন্য একটি হুমকী ও দুর্বল দিক ছিল। এজন্যই তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়।

**হুদাইবিয়ার সন্ধি**

কুরআনে যদিও মুসলিমদের হজ্জ্বের নিয়ম ও আবশ্যকীয়তা উল্লেখ ককরা আছে, তথাপি কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ্জ্ব আদায় করতে পারছিল না। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক দিব্যদর্শনে দেখতে পান তিনি হজ্জ্বের জন্য মাথা কামাচ্ছেন। এ দেখে তিনি হজ্জ্ব করার জন্য মনস্থির করেন এবং ৬ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবা নিয়ে মদীনার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু এবারও কুরাইশরা বাঁধা দেয়। অগত্যা মুসলিমরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে। এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে সুপরিচিত। এই সন্ধি মতে মুসলিমরা সে বছর হজ্জ্ব করা ছাড়াই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। সন্ধির অধিকাংশ শর্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেলেও মুহাম্মাদ এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।

**বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ**

রাসূল (সাঃ)সারা বিশ্বের রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। সুতরাং পৃথিবীর সব জায়গায় ইসলামের আহ্বান পৌঁছ দেয়া তাঁর দায়িত্ব ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলো থেকে আশ্বস্ত হয়ে এ কাজে মননিবেশ করেন। সেসময়ে পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য (the holy roman empire),এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের ‘আযীয মুকাউকিস’,ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই ষষ্ঠ হিজরীর জিলহজ্জ মাসের শেষদিকে একইদিনে এদেঁর কাছে ইসলামের আহ্বানপত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন।

**প্রেরিত দূতগণের তালিকা**


দািহয়া ক্বালবী (রাঃ)কে রোমসম্রাট কায়সারের কাছে।
আবদুল্লাহ বিন হুযাফা (রাঃ)কে পারস্যসম্রাট পারভেজের কাছে।
হাতিব বিন আবূ বুলতা’আ (রাঃ) কে মিশরৈর শাসনকর্তার কাছে।
আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) কে হাবশার রাজা নাজ্জাশীর কাছে।
সলীত বিন উমর বিন আবদে শামস (রাঃ) কে ইয়ামামার সর্দারের কাছে।
শুজাইবনে ওয়াহাব আসাদী (রাঃ)কে গাসসানী শাসক হারিসের কাছে।

শাসকদের মধ্য হতে শুধুমাত্র বাদশাহ নাজ্জাসী ছাড়া আর কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি।

**মক্কা বিজয়**

দশ বছরমেয়াদি হুদাইবিয়ার সন্ধি মাত্র দু’ বছর পরেই ভেঙ্গে যায়। খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র,অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। একরাতে বকর গোত্র খুযাআদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহয়োগিতা করে। কোন কোন বর্ণনামতে কুরাইশদের কিছু যুবকও এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ (সঃ) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র প্রেরণ করেন এবং কুরাইশদেরকে এই তিনটি শর্তের যে কোন একটি মেনে নিতে বলেন। শর্ত তিনটি হলো;

(1) কুরাইশ খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে।
(2) অথবা তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে।
(3) অথবা এ ঘোষণা দিবে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

কুরাইশরা জানালো যে, তারা শুধু তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবে। কিন্তু খুব দ্রুত কুরাইশ তাদের ভুল বুঝতে পারলো এবং আবু সুফয়ানকে সন্ধি নবায়নের জন্য দূত হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করলো। কিন্তু মুহাম্মাদ (সঃ) কুরাইশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করলেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ (সঃ) দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন।সেদিন ছিল অষ্টম হিজরীর রমজান মাসের দশ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনাপ্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলো এবং মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীবেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। তবে দশজন নর এবং নারী এই ক্ষমার বাইরে ছিল। তারা বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সঃ)এর কুৎসা রটাত। তবে এদের মধ্য হতেও পরবর্তিতে কয়েকজনকে ক্ষমা করা হয়। মক্কায় প্রবেশ করেই মুহাম্মাদ (সঃ) সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করেন। মুসলমানদের শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ (সঃ)এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করে। কোরআনে এই বিজয়ের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।

*****মৃত্যু****

বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ)এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল,মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসে তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আলী (রাঃ) তাকেঁ গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশ (রাঃ)এর কামরার যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন,জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়।

**ইসলামী বর্ণনামতে মুহাম্মাদের অলৌকিকত্ব**

ব্যতিক্রমের প্রতি আকর্ষন মানুষের স্বভাবজাত, অন্যদিকে অলৌকিকত্বের প্রভাব আমাদের লৌকিক জীবনে সুদূর প্রসারী। আরবী মু’জেযা শব্দের অর্থ আসাধারন বিষয়, অলৌকিকত্ব। মুহাম্মদের [স.] অসংখ্য মু’জেযার মধ্যে প্রকাশ্য মু’জেযার সংখ্যা দশ হাজারেরও অধিক।[৮] ব্যাখ্যাকারীগণ মুহাম্মদের [স.] মু’জেযাগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। প্রথমত যা তাঁর দেহ হতে বহির্ভূত। যথা- চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া, বৃক্ষ নিকটে আসা, ঊট ও হরিনের অভিযোগ ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত যা তাঁর দেহসম্পৃক্ত যথা- ‘মহরে নবুওয়াত’ যা হলো দুই কাঁধের মাঝখানে আল্লাহর রাসূল মোহাম্মাদ বাক্যটি লেখা ছিল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। তৃতীয়ত তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী যথা- নির্ভিক, অকুতোভয়, দানশীল, সত্য ভাষণকারী, দুনিয়াবিমুখ ইত্যাদি। আল কোরানের সুরা ক্বামারে মুহাম্মদের [স.] আংগুল দ্বারা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে। বদর যুদ্ধের আগের দিন বদর নামক স্থানে পৌঁছে মুহাম্মদ [স.] বললেন ‘এটা আমুকের শাহাদাতের স্থান, এটা অমুকের (কাফেরের) হত্যার স্থান… সাহাবীরা (রা.) বলেন ‘রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার জন্য যে স্থান দেখিয়েছেন, তার সামান্য এদিক সেদিক হয়নি।’ (মুসলিম) বিভিন্ন যুদ্ধে আকাশের ফেরেশতাগন অংশগ্রহন করতো। যা আল্লাহর সাহায্য ও রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মু’জেযার প্রমান। হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন- ‘ ওহুদের যুদ্ধের দিন আমি রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডানে বামে সাদা পোষাকের দু জন কে (জিব্রাইল, মিকাইল) দেখলাম যাদের কে আর কোন দিন দেখেনি। (বুখারী, মুসলিম) সাহাবীর ভাংগা পা রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্পর্শে ভালো হওয়া আরো একটি মু’জেযা। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক (রাঃ) এর পা ভেংগে গেলে তিনি তা রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জানালে রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পায়ের উপর হাত বুলালেন। সাহাবী বলেন- ‘ এতে আমার পা এমনভাবে সুস্থ হয়ে গেলো যেন তাতে আমি কখনো আখাতই পাইনি। (বুখারী) স্বল্প খাদ্যে হাজার মানুষের পরিতৃপ্ত ভোজন হওয়া প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উল্লেখযোগ্য মু’জেযা। এরুপ বহু ঘটনা বহু সাহাবী বর্ণনা করেছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় যখন রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল সাহাবীগন ক্ষুধায় অস্থির ও দুর্বল হয়ে পরেছিলেন তখন জাবের (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা জবাই করলেন আর এক সা পরিমান জবের রুটি তৈরি করলেন আর তা দিয়েই সবাই তৃপ্তিতে খেলেন। সাহাবী জাবের (রাঃ) আল্লাহর শপথ করে বলেন- ‘সকলে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যাওয়ার পরও চুলায় গোশত ভর্তি ডেকচি ফুটছিল এবং রুটি হচ্ছিল।’(বুখারী, মুসলিম)

****মুহাম্মাদ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি****

***ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি***

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মুহাম্মাদের অবদান

**নব্যুওয়তের মোহর**

এই অনুচ্ছেদ উইকিপিডিয়ার জন্য মান সম্পন্ন অবস্থায় আনতে পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন। (প্রয়োজনে আরও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিন।) সম্ভব হলে অনুগ্রহ করে অনুচ্ছেদ এর মান উন্নয়ন করুন। আলাপ পাতায় এই সংক্রান্ত বিস্তারিত বর্ণনা থাকতে পারে। (নভেম্বর ২০১১)

বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্থ- বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী শরীফে মুহাম্মদের [স.] নব্যুওয়তের মোহর সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ছায়েদ ইবনে ইয়াযীদ [রা.] কর্তৃক বর্ণিত এমর্মের একখানা হাদিস উদ্বৃত করা হয়েছে যে, ছায়েব (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিঠের পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন দেখতে পেলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র দুই কাঁধের ঠিক মধ্যস্থলে চাতক পাখির ডিমের আকৃতির মাংসখন্ডে নব্যুওয়তের মোহর অঙ্কিত রয়েছে। এর চারপাশ মসৃণ কেশ দ্বারা পরাবৃত। আমি একটু ঝূঁকে সেটির নিকট নাক দিয়ে শুঁকছিলাম। আমার নিকট তখন কস্তুরীর সূগন্ধ অনুভূত হচ্ছিল। নব্যুওয়তের মোহর-এর অভ্যন্তরভাগে লেখা ছিল “আল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু ওয়া মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম”[৯]র্থ হচ্ছে আল্লাহ এক তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এর উপরিভাগে অঙ্কিত ছিল যে দিকে ইচ্ছা বিচরন করুন, কেননা আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য প্রাপ্ত। অহী নাযিল হওয়ার আগ মুহূর্তে ৩য় বারের মত যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছিনাচাক হয়, তখনই পিঠের মধ্যস্থলে শরীরের উপরিভাগে নব্যুওয়তের মোহর অঙ্কিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যুর পর নব্যুওয়তের মোহর যা উনার পিঠে অঙ্কিত ছিল সেটি মুছে যায়। এটা দেখেই সাহাবীরা বুঝেন যে উনি ইন্তেকাল করেছেন।

**মুসলিমদের শ্রদ্ধা নিবেদন**
**চিত্র বা ভাস্কর্যের মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ**
**খ্রিস্টান ও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি**

প্রখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক মি. এডওয়ার্ড টিম্বার প্রৃথিবীর মহাপুরুষগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ১৭ জন মহাপুরুষের নাম the faith and Favour পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে প্রিয় নবিজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম প্রথমে স্থান পেয়াছে। নোবেল বিজয়ী চিন্তাবিদ প্রখ্যাত সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ডশ রাখঢাক না করেই বলে গিয়েছেন, বিশ্ববাসী! যদি তোমরা নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে চাও এবং সর্বাঙ্গীন সুন্দর জীবন ব্যবস্থা কামনা করো, তবে বিশ্ব-সংসারের নিয়ন্ত্রন ভার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে ছেড়ে দাও। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন, যাকে না হলে বিশ্ব অসম্পুর্ন থেকে যেতো। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর কৃতিত্বময় ইতিহাস মানব জাতির ইতিহাসে এক সমুজ্জল অধ্যায় রচনা করেছে। আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদী প্রফেসর জুল ম্যাসারমান বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, সর্বকালের সর্বশ্র্রেষ্ঠ অনুসরনীয় ও অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হিলফুল ফুযুল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আরবে যখন জন্ম হয়, তখন যুদ্ধ ছিল সেখানকার একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শৈশবেই এ সকল যুদ্ধ তাকে প্রচন্ড বেদনাহত করে। তাই যৌবনের প্রারম্ভে তাঁর একান্ত অনুপ্রেরনায় ও উদ্যোগে হিলফুল-ফুযুল নামক একটি সেবাসংঘ গঠিত হয়। এই সংঘের লক্ষ্য ছিল সমকালিন যাবতীয় অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, দরিদ্রের দারিদ্র মোচন করা, অত্যাচার ও অনাচারের প্রতিরোধ করা। এই সংঘের সকল সদস্য তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন। মক্কার কোন নির্যাতিত ব্যক্তি হিলফুল-ফুযুল এর কাছে সাহায্য চাইলে এই সংঘের সবাই সম্মেলিত ভাবে তাকে সাহায্য করত। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরবর্তীকালে বলেছিলেন, আমাকে যদি এই সংঘের বদলে অনেকগুলো লাল উটও উপহার দেয়া হয় তা হলেও আমি ও গুলো গ্রহণ করবো না। কোনো ব্যক্তি যদি এই সময় হে হিলফুল ফুযুলের সদস্যগন বলে ডাক দেয়, আমি অবশ্যই তার ডাকে সারা দিব। তথ্য সূত্রঃ মাসিক মদিনা, সীরাতুন্নবী সংখ্যা, ২০১০, ফারাবী